No title

হিংসা নয়, ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র,  মানুষের জাত নয়, মানুষজাতটাই সবার উপরে

সাংবাদিকতার সূত্রে ওই ২০০৩ সালের মধ্যেই আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি। দেখেছি অজস্র মৃত্যু, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীদের দেখেছি খুব কাছ থেকেই। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সফরসঙ্গী হয়েছি। দেখেছি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধায়এর রাজনৈতিক উত্থান, অগ্নিকন্যা হয়ে ওঠা। তার সঙ্গে বেরিয়েছি জন-সংযোগ যাত্রায়, সাংবাদিক হিসাবে। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সফর, বিজেপির লালকৃষ্ণ আদবানীর রথযাত্রার সাক্ষী যেমন থেকেছি, তেমনই ছুটে গেছি অমরনাথে যখন উগ্রপন্থী হানায় বহু তীর্থযাত্রীর মৃত্যু হয় ১৯৯৪ সালে, দেখেছি সাদার মাঝে রক্তের ছিটে। নিশ্চুপ বয়ে যাওয়া অলকানন্দা। 
জীবন-মৃত্যুতে ভরা ভারতের মাঝে তখন আমি খুঁজে চলেছি ভারত আত্মাকে। জাতের নামে বিভাজন সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফয়দা লোটা দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছি রাজনীতির উপর। অথচ, তখন আমি একটি ইংরাজী দৈনিক সংবাদপত্রের রাজনৈতিক সাংবাদিক। ইংরেজদের ফেলে যাওয়া ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ আজও সকলের হাতে শাসনের এক মারাত্মক অস্ত্র। জাত-পাতের দোহাই দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভাজন, এটা এক শ্রেণির অস্ত্র। 
ঠিক এই সময়, এক মহামানবকে দেখলাম, যেমন শুনেছিলাম স্বামী বিবেকানন্দের কন্ঠে, “মুচি, মেথর, দীন দরিদ্র আমার ভাই……”। এনাকেও দেখলাম, মানুষের সৃষ্টি করা ‘বর্ণ-প্রথা’র চমতকার ব্যাখ্যা দিতে। সত্যিই তো! মানুষতো তার কর্মে জীবিত থাকে। জন্ম যেখানেই হোক না কেন, কর্মের গুণে মানুষ সকলকে আলোকিত করে। কবির কথা – ‘জন্ম হউক যথা-তথা, কর্ম হউক ভাল…”
এই আধুনিক ভারতে, যেখানে, এখনো মানুষে-মানুষে এত ভেদাভেদ। অন্য জাতের মধ্যে নয়, নিজেদের জাতের মধ্যেই ভেদ সৃষ্টি করে মানুষ নিজেই অন্য মানুষকে শত্রু বানিয়ে ফেলছে। এর শেষ কোথায়? শেষ দেখাতে চেয়েছিলেন শ্রীশ্রী স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া, যিনি জাতের ভন্ডামীকে চিনেছিলেন। চিনতে পেরেছিলেন ধর্মের মাঝেও বয়ে চলেছে অধর্মের এক চোরা স্রোত। 
দেখতে পেয়েছিলেন, একশ্রেণির মানুষের মধ্যে লোভের আগুন। তাই তিনি চেয়েছিলেন মানুষের অন্তরকে শোধন করতে। পেরেছিলেন, বা পারলেন কি না, তার উত্তর ভবিষ্যত দেবে। আমি আবার ফিরে যাই ২০০৩ সালের ১৩ চৈত্রে। ভোরের আলোয় এক নতুন ‘নতুনগ্রাম’ দেখেছিলাম, দেখেছিলাম এক সত্যিকারের আশ্রম। খোলা নীল আকাশের নীচে সবুজের সমারোহ। আমবাগান থেকে আমের বকুল আর কচি আমের সুগন্ধ আর কোকিলের ডাক। মন ভরিয়ে দেয়। 
আশ্রমের পিছন দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্যানেল,। তখনো পীচের রাস্তা হয়নি। লাল মাটি, কোথাও সরু আলপথ দিয়ে হেটে গেছি ব্যান্ডেল-কাটোয়া লাইনের ধারে শ্রীদাদাজী মহারাজের সমাধি-মন্দিরে। তখন, ওখানে কোন লেভেল ক্রসিং ছিল না। একটা বড় দুর্ঘটনা হয়। মারা যান শ্রীবাবাজী মহারাজের আশ্রম থেকে ফেরার পথে এক দম্পতি ও তার মেয়ে। সঙ্গে থাকা ছেলেটি ভাগ্যক্রমে রক্ষা পান। শুনেছি, রেললাইনের উপর তাদের গাড়িতে ধাক্কা মারে ট্রেন। নিমেষে শেষ হয়ে যায় একটা স্বপ্নের পরিবার।
আজ আমরা দীক্ষা নেবো। আগে থেকে আমার স্ত্রীর সিদ্ধান্ত ছিল, তিনি শ্রীবাবাজীর কাছেই দীক্ষা নেবেন। আমি কিছুই ভেবে আসিনি। অবশ্য এর আগে দীক্ষা নেওয়ার জন্য অন্য আশ্রমে গেছি, কিন্তু সবকিছু দেখার পর সেই ইচ্ছেটা আর জাগে নি। 
কেন, এই কথা বললাম, তার অনেকটাই মুখে বলা বা লিখে বলা সমীচিন নয়, বুঝে নিতে হয়। এবারে মনের মধ্যে সেই সুপ্ত ইচ্ছাটা আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে। এই তো সুযোগ! এ সুযোগ আর পাবো না। দীক্ষা কী, কীভাবে হয়, দীক্ষা নেওয়ার পর কী হবে, কিছুই জানতাম না, শুধু বিশ্বাস ছিল, আমি ঠকবো না, কারণ, ওই জ্ঞানের ভান্ডার থেকে কয়েক ফোঁটা পেলেও আমি ভাগ্যবান হয়ে যাবো।

যাইহোক, আবার আশ্রমে ফিরে এলাম। এর মধ্যেই ঘুরে দেখে নিয়েছি আশ্রমের একটু আগেই কয়েকজন তাঁত শিল্পীর বাড়ি। তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শ্রীবাবাজী এখানে আসার পর গ্রামের মানুষ কতটা উপকৃত হয়েছেন। দেখতাম তোতা নামের একটি মেয়ে বাবাজীর জন্য ফুল-আহার আনতো। দেখেছি কাকলি নামে আর একজন তরুণীকে। কী অসাধারণ সেবা করতেন তারা সকলে। গ্রামের মানুষের মধ্যে এক অদ্ভুত উদ্দীপনা। শ্রীবাবাজীর পাঠ শুনতে আসতেন বহু মানুষ। মুগ্ধ বিষ্ময়ে তারা দেখতেন নব ভারতের আর এক সন্ন্যাসীকে, যিনি কর্মের মাধ্যমে, ভক্তির মাধ্যমে, ধর্মের মাধ্যমে আর এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছিলেন।
তখনো রাস্তা কাঁচা। কিন্তু, গ্রামের ছেলেমেয়েদের কষ্ট করে পড়তে যেতে হয় না অগ্রদ্বীপে। শুনেছিলাম, শ্রীজানকীদাসজীর নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন বাবা। সম্ভবতঃ তখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। গ্রামের মানুষজন ভিড় করতেন বাবাজীর আশ্রমে, সকাল-সন্ধ্যায়। নতুনগ্রাম আশ্রমে তখন স্বর্ণযুগ। আমার এখন মনে হয়, ওই আশ্রমটাই অনেক ভালো ছিল। আশ্রম বিস্তার লাভ করলে, অনেক বেনো জল ঢুকে পড়ে। 
আশ্রম যত বড় হয়, আশ্রমের সম্পদ যত বাড়তে থাকে, তার সঙ্গে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সমস্যা। যাই হোক, সত্যি বলতে কী, তখন আশ্রমে যাদের সর্বক্ষণ চোখে পড়তো, তাদের একজন হলেন রাধামাধব। বাইরে থেকে আসা ভক্তদের থাকার, খাওয়ার, চা-জলখাবার দেওয়া- সব সামলাতো। ভক্তরা যখন প্রসাদ পেতেন, সেখানেও তার উপস্থিতি। শ্রীবাবাজীকে বেশ কয়েকবার বলতে শুনেছিলাম পরবর্তীকালে, রাধামাধব আর বিষ্ণুদাস আমার 
বাম হাত আর ডান হাত। 
আর দেখেছিলাম তরুণদাকে। পরে শুনেছিলাম তার জীবনের করুণ অধ্যায়। দেখেছিলাম পিসীমাকে। দেখেছিলাম বর্তমান সদগুরুকে। অর্ঘ্য পত্রিকায় ‘সুকান্ত বাগচি’ র 'কাঁচাপাকা' বেশ ভালো লাগত। এসব পরবর্তী সময়ে কথা।
 সদগুদাসজীর লেখা শ্রী বাবাজী মহারাজের জীবন চরিত থেকে জানতে পারি, শ্রী বাবাজী মহারাজ এই নতুনগ্রামে প্রথম আসেন ১৯৯৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী। ঘোষালদের এই কাছারীবাড়ি পরবর্তীকালে রূপ নেয় শ্রীদাদাজী মহারাজজীর নামাঙ্কিত তপোবন আশ্রমে। কিন্তু, কী অদ্ভুত লিখন। শ্রীবাবাজী মহারাজ যেদিন  এই  আশ্রমে আসেন, সেদিন ছিল ২৮ ফেব্ররুয়ারী আর যেদিন, এই আশ্রম ত্যাগ করে চিরকালের জন্য অনন্তলোকে চলে যান, সেদিনও ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারী, সালটা  শুধু ২০১৪।
 
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad