শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ১৭

শ্রীবাবাজী মহারাজের আর এক মন্ত্রশিষ্য পার্থপ্রতীম সুর। ছাত্রজীবনেই তিনি শ্রীবাবাজীর কাছে মন্ত্র নেন ২০০৪ সালে। পরবর্তী সময়ে কর্মসূত্রে চলে যান দিল্লিতে। বিবাহের পর তার ইচ্ছা ছিল স্ত্রীকেও শ্রীবাবাজীর কাছে  মন্ত্রদীক্ষা দিতে। কিন্তু সে সময় আর হয় নি। তার আগেই বাবাজী চলে গেছেন অমৃতলোকে। শেষপর্যন্ত, তিনি মন্ত্র নেন, শ্রীবাবাজীর আর এক প্রিয় সাধু-শিষ্য তপোবন আশ্রমের তৎকালীন মহন্ত শ্রীবিষ্ণুদাসজীর কাছ থেকে। পার্থপ্রতীম আগামী সোমবার থেকে শোনাবেন তাদের জীবনে শ্রীবাবাজীর ভূমিকা, কীভাবে, তিনি দেহান্তের পরও তাদের আঁকড়ে রেখেছেন, তাদের পাশে আছেন, সেই কাহিনি।

কেউ কর্ম করে যায়, কেউ ভোগ করে তার ফল, কিন্তু কর্মফল? সেটা কে ভোগ করে?

তারক ঘোষ 

পর্ব ১৭ 


 আজ রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন কবিতার দুটি মাত্র লাইন দিয়ে শুরু করি – 
“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, 
নিভাইছে তব আলো, 
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?” 
এর উত্তর যদি আমি শ্রীবাবাজীর কাছে চাইতে পারতাম, তিনি একবাক্যে বলে দিতেন –“হ্যাঁ”। 

 শ্রীবাবাজী ছিলেন এক কঠোর মানব, কিন্তু অন্তর ছিল শিশুর মতো। কিন্তু, কেন কঠোর? তার কারণ আমার মনে হয়েছে, তিনি ধর্মের প্রকৃত অনুশাসন, সন্ন্যাসীর নিষ্ঠা আর নিয়মের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। তিনি ষড়রিপুকে দমন করতে পেরেছিলেন, যা বহু সন্ন্যাসী পারেন না। অথচ, এই ষড়রিপুকে জয় করতে না পারলে প্রকৃত মুক্তি আসে না। বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে হয়। 
 এই সংসারে সবচেয়ে বড় রিপু, অনেকে বলেন রাগ। রাগ আগুনের মতো- সবকিছু ধ্বংস করে। আমি বলি, সবচেয়ে বড়ো রিপু লোভ। লোভের চাদরে মুড়ে আছে এই পৃথিবী। চারিদিকে লোভের হাতছানি। সেই লোভের নানা চেহারা। নানা রূপ। তাকে চলে যেতে বলে, এমন সাধ্য কার? সম্পত্তির প্রতি লোভ, নারীর প্রতি লোভ, অর্থের প্রতি লোভ, সম্মানের লোভ, পদের লোভ, ক্ষমতার লোভ – মানুষের লোভের শেষ নেই। তাই প্রথমে আসে লোভ। 
আর এই লোভ পূরণ না হলে, বা এই লোভ পূরণে কেউ বাধা দিলে, আসে রাগ। আর সেই রাগ থেকেই জন্ম নেয় অত্যাচার-অনাচার। রাগের আগুনের জন্ম লোভের জঠর থেকেই। কাজেই যিনি লোভ জয় করতে পেরেছেন, তিনিই সন্ন্যাসী- তিনি গৃহত্যাগ করে সাধু হয়েই যান, কিংবা সংসার ধর্মই করুন। মনে যার সন্ন্যাস, তিনিই সন্ন্যাসী। 
বাবাকে বলতে শুনেছি –‘মন জিতে তো সংসার জিতে।‘ 


বাবা মাঝে মাঝেই ভক্তদের বলতেন, তোরা তো আশ্রমে গোটা সংসারটাই বয়ে নিয়ে আসিস। এখানে বসে, বাড়ির কথা ভাবিস, কে কী করছে, সেই চিন্তাতেই মশগুল বেশি থাকিস। দু একদিন সংসার ভুলে দেখনা, তোর সংসার চলে, না চলা বন্ধ করে দেয়। 
আমার শাশুড়ীকে একবার বলেছিলেন, ভবী ভুলবার নয়। তিনি, তার সংসার নিয়ে বার বার বাবাকে প্রশ্ন করছিলেন আশ্রমে আসা থেকেই। 
বাবাজী বলেছিলেন, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে দুটো সত্বা আছে। একটা ভালো, একটা মন্দ। সাধুদের কাজ ভালো সত্বাটাকে জাগিয়ে তোলা। আমি মানুষকে সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিই। 
তাই মানুষের প্রথম কর্তব্য হলো লোভ জয় করা। কথাটা মুখে বলা যত সহজ, কাজে করা সহজ নয়। যদি সহজ হতো, তাহলে আমরা অন্য এক বিশ্ব দেখতে পেতাম। আশ্রমগুলো হয়ে উঠত ঈশ্বরের আবাস। 
কিন্তু, সেটা দেখছি কোথায়? কেউ কর্ম করে যায় নিঃস্বার্থভাবে, কেউ ভোগ করে তার ফল। আর এটাই ক্রমশঃ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে চারিধারে। 


লোভকে জয় করার মন্ত্র কি? 
সত্যি আছে না কি? 
আছে। 
নিজের মনকে প্রশ্ন করুন। 
আমার ভালোভাবে বেঁচে থাকতে কতটা প্রয়োজন? 
যে সম্মানের আমি আশা করছি, সেই সম্মান পাওয়ার অধিকার আমার আছে কি? 
জিজ্ঞাসা করুন, আমি আমার স্ত্রীকে কতোখানি ভালোবাসি? তাহলে, অন্য নারীকে কল্পনা করি কেন? জিজ্ঞাসা করুন, ক্ষমতা পেলে আপনি সেই ক্ষমতাকে কোন কাজে লাগাবেন? ধংসের? না সৃষ্টির? নিজের মনকে, প্রশ্ন করুন, পদের জন্য, আমি কোন পথে এগোবো? সৎ, না অসৎ? 
সেই পদ পেলে, আমি কি করবো? 
অনেকগুলো প্রশ্ন। দিনের শেষে, বিছানায় শুয়ে ভেবে দেখুন, আপনি সারাদিনে কী কী কাজ করেছেন, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। যেদিন এই ভালো-মন্দের পার্থক্যটা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, সেদিন আর ষড়রিপু আর আপনাকে জ্বালাবে না। 


 শ্রীবাবাজী ছিলেন এক নির্লোভ মহাপুরুষ। তাই তিনি কর্ম করে গেছেন। মানুষের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। তার দয়ায়, দানে অনেক মানুষ উপকৃত। বাবাজী মানুষের অন্তঃপুর আর বাহ্যরূপের সংষ্কার সাধন চেয়েছিলেন। তাই দিনের পর দিন ছুটে গেছেন ভক্তদের ডাকে, ঘুরে বেরিয়েছেন এই ভারতের তীর্থক্ষেত্রে। 
আশ্রমে বা যেখানেই তিনি যেতেন, সেখানেই বসতো পাঠচক্র। ভারতের প্রাচীন সংষ্কৃতিকে স্মরণ করিয়ে দিতেন আধুনিকতার মোড়কে। 
বাবাজী একটা কথা বারবার বলতেন – ‘পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।‘ তিনি এই প্রসঙ্গে, নানা গল্প বলেছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন। 
অনেকে আমাকে অন্য মহাপুরুষদের কথা স্মরণ করিয়ে বলেছেন, পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়। সত্যি বলছি, আমি এ কথা মেনে নিতে পারিনি। হিসাব বলে, যে ব্যক্তির শরীরে পাপ বাসা বাঁধে, সেই পাপী। তাহলে, আমি পাপকে ঘৃণা করে, তার আবাসকে কীভাবে ভালোবাসবো? 
একজন বিচারক, আদালতে, কোনো পাপের জন্য, কীভাবে পাপকে ঘৃণা করে পাপীকে ছেড়ে দেবেন? কে জেলে যাবে? পাপ, না, পাপী? কে মৃত্যুদন্ড পাবে? পাপ নিজে, না কি পাপী? 
আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি, বাবার কাছে এই প্রশ্ন বহুবার করবো ভেবেও করা হয়নি। তাহলে, ওই কথার প্রকৃত ব্যাখ্যা কী? 
বাবা বলতেন, পাপের দায় কেউ নেয় না। পূণ্যের দায়ও কেউ নেয় না। যিনি পাপ করছেন, বা পূণ্য করছেন, সবটাই তিনি নিজে পাবেন। তাই তিনি বলতেন, যে কোনো কাজ করার আগে দু বার ভাব। তারপরে সেই কাজ কর। কর্মফল, এই জীবনেই ভোগ করে যেতে হয়। 
২০০৩ সালের গ্রীষ্মে আমরা দীক্ষা নিই। আর সে বছর শীতে প্রথম গীতাযজ্ঞ দেখি। শ্রীদাদাজী মহারাজের যেখানে সমাধি মন্দির। রেললাইনের ধারে, সেখানেই হয়েছিল এই গীতা যজ্ঞের আয়োজন। সে এক অবিষ্মরণীয় স্মৃতি। সেদিন আকাশে শুধু কুয়াশা। হাল্কা হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছিল চরাচর। কুয়াশার অবগুন্ঠনে রচিত হচ্ছিল জীবনে অন্য এক রূপ।
  আগামি সোমবার


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad