শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ১০

হাজার সাধু শিষ্য পাওয়া যাবে, কিন্তু একজন প্রকৃত গৃহী শিষ্য পাওয়া খুব কঠিন। 



 ‘যেমন দেখেছি তাঁরে’ আমার একান্তই নিজের অভিজ্ঞতা আর অনুভুতির কথা। শ্রীবাবাজী মহারাজের আশ্রম ও তাঁকে আমি যেভাবে দেখেছি, আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি, সেই কথাই আমি বলার চেষ্টা করেছি। হয়তো, অনেকে আমার সঙ্গে সহমত হবেন, হয়তো, অনেকে হবেন না। কিন্তু, একজন শিষ্য, বিশেষ করে গৃহী শিষ্য যেভাবে তার গুরুকে পেতে চান, সেই সব কটি গুণের সমাবেশ ছিল তার মধ্যে। 
অগ্রদ্বীপের এই তপোবন আশ্রমে আমি দেখেছি ধর্মময় এক জগতে কর্ম, জ্ঞান আর ভক্তির বিচ্ছুরণ। কর্ম ছাড়া জগত যে অচল ,তা আমাকে প্রতি মুহুর্তে বুঝিয়ে দিয়েছে আশ্রমে দৈনিক কর্মের প্রবাহ। শ্রীবাবাজী্র ভক্তি, সেবা আর কর্মের আদর্শ আমার সামনে তুলে ধরেছিল, ধর্মীয় নবজাগরণের আর এক নতুন দিগন্ত ।  


ধর্ম কি কর্ম ছাড়া হতে পারে, শিষ্যের প্রতি একজন গুরুর দায়িত্ব কী, গ্রামের মানুষজন একজন গুরুর কাছ থেকে কী দাবি করতে পারেন, আর কী পান। ধীরে ধীরে সব দেখেছি। আমি এই নিবন্ধে, ধর্মের জটিল তত্ব নিয়ে আলোচনা করছি না, যেটা করছি সেটা উপলব্ধির কথা। গুরুকে যদি সম্যকভাবে উপলব্ধি করা না যায়, তাহলে শিষ্যের কাছে গুরুর স্বরূপ উদঘাটিত হয়না। গুরু আমার কাছে শিক্ষক। এক প্রকৃত মানুষ গড়ার কারিগর। তার বকা-ঝকার মধ্যেও থাকে শিক্ষা। যা থেকে আমরা আমাদের ভুলগুলো দেখতে পাই, সংশোধন করতে পারি। 
 শ্রীবাবাজী মহারাজ ধর্মের মধ্যে মানুষকে নিমজ্জিত করে রাখতে চাননি। বরঞ্চ ধর্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে, মানুষকে কর্মের মধ্যে নিমজ্জিত করতে চেয়েছিলেন। সেই কর্ম ফলের আশা করে না, কিন্তু সংসার জীবনে থেকেও পৌছে দিতে পারে বন্ধনহীন আনন্দের হাটে। 
আশ্রমে আসা বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলতাম। জানতে চেষ্টা করতাম, কেন তারা আশ্রমে আসেন। আমাকেও তারা পালটা প্রশ্ন করতেন, শ্রীবাবাজীর কাছ থেকে আপনি কী পেলেন? অনেকেই বলতেন শান্তির খোঁজে। জিজ্ঞাসা করতাম, কীরকম শান্তি? তাদের ভিন্ন ভিন্ন উত্তর থেকে, আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, মানুষ যেমন বিপদে পড়লে ডাক্তার, উকিল, জ্যোতিষীর কাছে যান, অনেকে সেই রকম আশ্রমে ছুটে আসেন। ধর্মের মধ্যে কয়েকদিন থেকে সংসার-তাপে পুড়ে যাওয়া হৃদয়টাকে শান্ত করতে। অনেকে আসেন, বেড়াতে আসার মতো। কটা দিন দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমী থেকে ছুটি খুঁজতে। অনেকে আসতেন, গুরুকরণের জন্য। অনেকের কাছে শুনেছি, তাদের একজন গুরু দরকার। সমাজে অনেকের গুরু আছে, তাদেরও চাই। 
আর এক শ্রেণির মানুষ আসতেন, যারা বয়ে আনতেন যাবতীয় সাংসারিক অভিযোগ। মেয়ের বিয়ে, ছেলের চাকরি, এমনকি, জ্ঞাতিদের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমার বিষয় পর্যন্ত। আর এসবের বাইরে, আসতেন দু-একজন মানুষ। বাবার কাছে বসতেন, প্রসাদ পেতেন, চলে যেতেন। আবার আসতেন। তারা কোনদিন বাবার কাছ থেকে কিছু চাইতেন না, কিছু বলতেন না। শুধু মন দিয়ে শুনে যেতেন বাবার পাঠ। শ্রীবাবাজী মাঝে মাঝেই বলতেন, ভবী ভুলবার নয়। 

এটা স্বাভাবিক, গৃহী মানুষের জীবনে নানা সমস্যা থাকে, তাই তারা গুরুর কাছে সবটাই নিবেদন করেন, খুলে বলতে থাকেন। যদি, গুরু তাদের পথ বাতলে দিতে পারেন। এটা স্বাভাবিক একটা চাওয়া। এর মধ্যে পাওয়ার একটা আশা থাকে ঠিকই, কিন্তু তারা বিশ্বাসের এমন একটা জায়গায় অবস্থান করেন, তারা মনে করেন, গুরু তাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। 
কিন্তু, আমার মনে হয়, মানুষের নানা কর্ম তাদের ভবিষ্যত ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। কেউ যদি তাদের সন্তানকে টাকা উপার্জনের একটা মেশিনে পরিণত করার শিক্ষা দিতে থাকেন, তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে ‘খুব একটা’ ভালো ফল আশা করা যায় কি? আমি যদি আমার বাবা-মা কে সম্মান না করি, পুত্রবধূ যদি তার সন্তানদের দাদু, ঠাকুমা সম্মান করা ভালোবাসার শিক্ষা না দিতে পারেন, তাহলে তারা কী শিক্ষা পাবে? ভবিষ্যতে কি তারা সেই ‘শিক্ষাটাই’ ফেরত দেবে না? 
আসলে, কেউ যদি আশা করে যে কোন কাজ করেন, তাহলে, ভবিষ্যতে আশাহত হওয়ার একটা ব্যাপার থাকে, আর সেটাই বয়ে আনে দুঃখকে। সন্তান মানুষের মধ্যে কোন আশা রাখতে নেই, পিতা-মাতার কর্তব্য তাদের মানুষ করা। ভবিষ্যতের ‘ইনভেস্টমেন্ট’ হিসাবে মানুষ করলেই বিপদ। সেই আশা পূরণ না হলেই, আসে অশান্তি। সবাই এক নয় জানি, তবে, যে মানুষ ফলের আশা না রেখে কর্ম করেন, তার জীবনে অশান্তি খুব কম। কেননা, তার কোন চাওয়া থাকে না। 

শ্রীবাবাজী তাই বলতেন, সেই হলো প্রকৃত শিষ্য, যে আমার কাছে সাংসারিক বা পার্থিব কিছু চাইবে না, শুধু আমাকেই চাইবে। যিনি, ভগবানকে ভালোবেসে কর্ম করেন, যিনি গুরুর বাণী, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে অনুসরণ করেন, তার তো কোন কষ্ট থাকতেই পারে না। এ শিক্ষা আমি শ্রীবাবাজীর কাছ থেকে লাভ করেছি। বাবার কথা শুনে বুঝেছি, সাধু শিষ্যের চেয়ে গৃহী শিষ্য হওয়া খুব কঠিন। কেউ যদি প্রকৃত সাধু হন, তার মন একমুখী হবে। মনের মধ্যে থাকবে না কোন চঞ্চলতা। সংসার নয়, সাংসারিক লাভ-ক্ষতি থেকে তিনি দূরে থাকবেন। আর লোভ আর কামনা চিরতরে বর্জন করবেন।

 কিন্তু, গৃহী মানুষের মন শত দিকে ছুটছে। উপার্জন, সন্তান মানুষ করা, তাদের শিক্ষা, রোগ-ভোগ, মামলা-মোকদ্দমা, মৃত্যু, বিবাহ, সন্তানদের চাকরি – প্রতি মুহুর্তে সমস্যার ঢেউ। সমুদ্রের ঢেউ এর মতো যার বিরাম নেই। আসছে তো আসছেই। আর তার মধ্যে থেকেও ঈশ্বরকে ডাকা, জপ করা যে কী কঠিন, সেটা বাবা বুঝতেন, তাই বলতেন, হাজার সাধু শিষ্য পাওয়া যাবে, কিন্তু একজন প্রকৃত গৃহী শিষ্য পাওয়া খুব কঠিন।
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad