শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ৩০

সাময়িক গুণ ও কর্ম দেখে ব্যক্তির পরিচয় জানা খুব কঠিন। সেজন্য, সমাজে এখনও বাবা-মায়ের পরিচয় প্রাধান্য পাচ্ছে 

 অনেক সময় নিম্ন অধিকারী ব্যক্তির মধ্যেও সাময়িক সত্ব গুণের প্রাবল্য দেখা গেলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে আগের খারাপ সংস্কার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এরকম ব্যক্তির সাময়িক ভাবকে লক্ষ্য করে যদি তাকে আশ্রমের উচ্চ পদে অভিষিক্ত করা হলে, তার ভিতরের খারাপ সংস্কারের জন্য মানুষের যথার্থ কল্যাণ করতে পারে না।
তারক ঘোষ 

 পর্ব ৩০

 ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ এখনো চলছে সারা দেশ জুড়েই। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান থেকে প্রায়ই খবর আসে, শিক্ষকের হাতে দলিত ছাত্রের মৃত্যু, কিংবা কুয়োর জল নেওয়ার জন্য দলিত মহিলাকে হত্যা করার ঘটনা। কারণ কী? উত্তর হলো ছোট জাত বা নীচু জাত। তাই ওদের কপালে এই শাস্তি। শাস্তি দিচ্ছে কে? মানুষ। তার পরিচয় কি? সে উচু জাত। হায়রে মানুষ! 
 দেশ আজ অনেক উন্নত হয়েছে, মঙ্গলে পাঠানো হচ্ছে গবেষণা যান। শিক্ষায় দেশ এগিয়ে চলেছে, অথচ, এই জাতের নামে দেশ এখনো পড়ে আছে সেই মধ্যযুগে। সেখান থেকে কবে মুক্তি মিলবে, বা আদৌ মিলবে কি না আমরা জানি না। ফলে, দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকারীভাবেও আমাদের দিতে হচ্ছে জাত সংক্রান্ত তথ্য, সার্টিফিকেট। কাজেই, ধরে নিতেই হবে মুক্তির রাস্তা নেই। কিন্তু অত্যাচার বন্ধের রাস্তা আছে। 
বাবাজী মহারাজ পাঠচক্রে বসে, প্রায়ই এই ‘জাত প্রসঙ্গ’ তুলে, তার ব্যাখ্যা দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতের শ্রেণিবিভাগ হওয়া উচিত বৈজ্ঞানীক দৃষ্টিভঙ্গীতে। কিন্তু জানকীদাসজী মহারাজ সেই প্রথা ভেঙ্গে সমাজে বিশৃঙ্খলা আনার পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি বুঝেছিলেন, গুণ ও কর্ম অনুসারে কে ব্রাম্ভণ, কে ক্ষত্রিয় তা নির্ণয় করতে গেলে বেশি ক্ষেত্রেই বিবাদের সম্ভাবনা রয়েছে। কে এই বিচার করবে, তা নিয়েও দেখা দেবে মতভেদ। 
বাবাজী তাই বলতেন, “শ্রীবাবাজী মহারাজ (জানকীদাসজী মহারাজ) নতুন পদ্ধতি প্রচলিত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমানের পদ্ধতিকেই মেনে নিয়েছিলেন।“
এর একটা বৈজ্ঞানিক কারণ হিসাবে বাবাজী বলতেন – সৎ পিতামাতার সৎ সন্তান জন্ম নেয়। বিজ্ঞান এই তত্বকে জিন তত্ববলে। ভালো জিনের অধিকারী ভালো জিনের সন্তান জন্ম দেবে। বাবাজী একজায়গায় লিখছেন – “সাধু সমাজের মধ্যে এই আশা করেই পিতা-মাতার বংশ নিয়েই সূতাধারী (পৈতাধারী), মালাধারী (কণ্ঠীধারী) সাধুদের মধ্যে ভেদ করা হয়। 
দেখা যায়, অনেক সময় নিম্ন অধিকারী ব্যক্তির মধ্যেও সাময়িক সত্ব গুণের প্রাবল্য দেখা গেলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে আগের খারাপ সংস্কার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এরকম ব্যক্তির সাময়িক ভাবকে লক্ষ্য করে যদি তাকে আশ্রমের উচ্চ পদে অভিষিক্ত করা হলে, তার ভিতরের খারাপ সংস্কারের জন্য মানুষের যথার্থ কল্যাণ করতে পারে না। তাই সাময়িক গুণ ও কর্ম দেখে ব্যক্তির পরিচয় জানা খুব কঠিন। সেজন্য, সমাজে এখনও বাবা-মায়ের পরিচয় প্রাধান্য পাচ্ছে।“
বাবাজী মহারাজ দাদাগুরুজী প্রসঙ্গে আর একটি জায়গায় লিখছেন – “শ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজের একজন অব্রাম্ভন ডাক্তার শিষ্য ছিলেন। তার স্বভাব প্রকৃতিটি ছিল বড় সুন্দর। তিনি খুব জ্ঞান রাখতেন। বাবা মাঝে মাঝে খুব আক্ষেপ করে আমাদের বলতেন, ‘ডাক্তার কত ভাল মানুষ, তার কোন গুণ ব্রাম্ভণের চেয়ে কম নয়।‘ কিন্তু প্রচলিত অর্থে যে সমাজে অব্রাম্ভন বলে পরিচিত বাবা তাকে ব্রাম্ভণেরই মত দেখতেন এবং সেরকম ব্যবহার করতেন। আসলে, এই বর্ণভেদ এক প্রাচীন পদ্ধতি, সেখানে জন্মের ভিত্তিতে বর্ণ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু, বাবাজী মহারাজ বহু যুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে দেখিয়েছেন, এই পদ্ধতিতে কাউকে নির্দিষ্ট শ্রেণিতে ফেলে দেওয়া হলে, তার প্রতি অবিচার করা হয়। কিন্তু, তিনিও দাদাগুরুজীর মত বুঝতেন, এখনো সেই সময় আসেনি, কেননা সমাজ এখনো প্রস্তুত নয়। 
বাবাজী মহারাজ আর একটি বিষয়কে খুব গুরুত্ব দিতেন ও প্রায়ই ভক্তদের বলতেন। সেটি হল- অধর্ম যখন ধর্মের বেশে আসে, তখন তাকে চিনতে পারা বেশ কঠিন। ভগবান পবিত্রতার মূর্তি, তাই ভগবানের পথে যেতে হলে মনকে পবিত্র রাখতে হয়। অপবিত্রতা তিনি পছন্দ করেন না। আর পাপবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার রাস্তা হল গুরুদেবের কাছে তা প্রকাশ করা। পাপ প্রকাশ করে দিলে তা নষ্ট হয়ে যায়। তিনি দয়াময়, পাতকীকেও ক্ষমা করেন।

 

আশ্রমকে বাবা সেই প্রাচীন যুগের মতো রূপ দিতে চেয়েছিলেন। বহুবার দেখেছি, বাবাজী ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সকালে গীতা পাঠ করাচ্ছেন। তাদের দিন শুরু করছেন গীতার বাণী দিয়ে। মাঝে মাঝে তিনি নাটক অভিনয় ও গানের ব্যবস্থা করতেন। পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে জীবনকে বদ্ধ না করে শিল্প-সাহিত্য-সংষ্কৃতির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা জীবনকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন।
 
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad