ধর্ম, কর্ম, জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে একসূত্রে গাঁথতে চেয়েছিলেন বাবাজী মহারাজ
তারক ঘোষ
পর্ব ৩১
আগেই বলেছি, বাবাজীকে বুঝতে পারার ক্ষমতা আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষের নেই। তার জ্ঞানের পরিধি, সমাজচেতনা ও তার কার্যকরী প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি এক নূতন যুগের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। ধর্ম ও রাজনীতির সহাবস্থান তিনি অত্যন্ত অপছন্দ করতেন এবং বিষয়টা চিরকাল এড়িয়েই গেছেন। তিনি মনে করতেন মঠ ও মন্দির সাধকে জায়গা, ভক্তদের জায়গা। কাজেই সেই স্থানকে পবিত্র রাখার গুরু-দায়িত্ব সাধকদের। ভক্তদেরও একটা দায় আছে, তা হলো সাধকদের সঙ্গে এমন আচরণ করবেন না, যাতে তাদের মনের মধ্যে কোনরূপ রিপু স্থান না পায়।
অর্থ তাকে কোনদিন ছুঁতে দেখিনি, দেখিনি সাংসারিক আলোচনাকে গুরুত্ব দিতে। যে পূর্বাশ্রমকে তিনি ফেলে এসেছিলেন বহুদূরে, সেই পূর্বাশ্রম তার সাধক জীবনে কোন ছায়া ফেলে নি। তিনি ছিলেন এক নির্লিপ্ত যোগী, যার বিশ্বাস কর্ম-ধর্ম-জ্ঞান আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে।
আমাদের বর্তমান সমাজেও সাধু-সন্ন্যাসীদের একটা বিরাট সম্মানের আসন রয়েছে। আর সেই আসনের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব একমাত্র সাধকের বলেই মনে করতেন বাবাজী মহারাজ।
ভক্তের বিশ্বাস যাতে কোনরকম ভাবে আঘাত পায়, এমন কর্ম করতে তিনি সাধুদের নিষেধ করতেন। অনেকে বলেছেন, বাবাজী মন্দিরের বিস্তার করতে গিয়ে অনেক সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। আমি তার সত্যাসত্য জানি না, কিন্তু এটা জানি, বাবা যা কিছু করেছেন, সকলের মঙ্গলের জন্য। সাধু সমাজের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, ভক্ত সকলের জন্যই। হাজার হাজার ভক্তদের এসে যাতে প্রসাদ পেতে কষ্ট না হয়, তার জন্য মন্দিরের নীচে তৈরি হয়েছিল সুবিশাল প্রসাদ পাওয়ার জায়গা। তৈরি হয়েছিল স্নানের জন্য অনেকগুলি বাথরুম। থাকার জন্য ঘর। সবই ভক্ত-শিষ্যদের জন্য।
বাবাজীর হৃদয় ছিল কোমল, তাই ভক্তদের দুঃখকে নিজের মনে করতেন। সাবধান করতেন বার বার, যাতে দুঃখের কারণ হয়, এমন কর্ম তারা যেন না করেন।
আমি যখন, এই ধারার পূর্বতন মহাপুরুষদের কথা জানার জন্য বিভিন্ন বই পড়তে থাকি, তখন শ্রীশ্রী সন্তদাসজী রচিত একটি বই পাই, সেখানে তিনি তার বাবাজী শ্রীশ্রী রামদাসজী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন, বাবাজী মহারাজকে পুষ্করদাস নামে এক সাধু আহার্যের সঙ্গে শেকো বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। একবার ভাঙের সঙ্গে আর্সেনিক গোপনে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। ওই ভাঙ খেয়েছিলেন আরো তিন সাধু। খাওয়ার পর তারা অচৈতন্য হয়ে পড়েন।
বাবাজী মহারাজও বহু পরিমাণে ওই ভাঙ খেয়েছিলেন, কিন্তু তার কিছু ক্ষতি হয়নি। অপর মহন্তেরা ঢলে পড়েছেন দেখে, তিনি কমুন্ডুল থেকে তাদের উপর জল ছিটিয়ে দেন। তাদের চেতনা ফিরে আসে। এরপর ওই মহন্তরা ঠিক করেন পুষ্করদাসকে পুলিশের হাতে দেবেন। শ্রীবাবাজী মহারাজ তখন বলেন, ‘ওই ব্যক্তি আপন কর্মের ফল পাবে।‘ কিন্তু অন্যান্য মহন্তরা বললেন, ‘ওই ব্যক্তি হত্যাকারী। ওকে অবশ্যই পুলিশের হাতে দেওয়া দরকার।‘
শ্রীবাবাজী তখন বললেন, ‘তোমরা ইচ্ছা করলে পুলিশের কাছে যেতে পার, কিন্তু ওই ব্যক্তির কিছু করতে পারবে না। আমি বলব, ‘তোমরা যে ভাঙ খেয়েছ, আমি তার চেয়েও বেশি সেটা খেয়েছি, আমার তো কিছু হয়নি। সুতরাং, তোমাদের অভিযোগে কিছু হবে না, তোমরাই অপ্রস্তুত হবে।‘
বাবাজীর এই কথা অন্যান্য মহন্তরা মেনে নিলেন, পুষ্করদাস পরিত্রাণ পেল।“
শ্রীসন্তদাসজী লিখছেন – “এই পুষ্করদাস আবার বাবাকে বিষ দিয়েছিলেন, সেবারেও বাবা সেই বিষ হজম করেছিলেন। পুষ্করদাসের ধারণা ছিল, বাবার কাঠের আড়বন্ধ ছিল ফাপা, আর সেখানে অনেক মোহর লুকানো আছে। সে তাই ঠিক করেছিল, বাবাকে হত্যা করে সে ওই আড়বন্ধ নিজে ধারণ করবে। পুষ্করদাস এরপরেও বাবাজীকে হত্যা করার জন্য অন্যদের সাহায্যে বাবার উপর বিশাল আকৃতির পাথর নিক্ষেপ করায়।
এতে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যতদিন দেহে ছিলেন, ততদিন তিনি ওই আঘাতের যন্ত্রণা পেতেন, কিন্তু পুষ্করদাসকে বুঝতে দেন নি।“
আসলে, মহাত্মাগণ ক্ষমাধর্মে বিশ্বাসী। তারা জানেন, মানুষ তার কর্ম অনুসারে শাস্তি পায়।
পুষ্করদাসের মতো ব্যক্তিরা বারবার সমাজে আবির্ভূত হয়েছে। যীশুখৃষ্টকে তারা কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছেন, প্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের সঙ্গেও তারা যে ব্যবহার করেছেন, সকলেই তা জানেন। বাবাজী মহারাজও ক্ষমাতে বিশ্বাসী ছিলেন। আর বিশ্বাস করতেন কর্মে। কর্ম আর ধর্মের মাঝে বিজ্ঞানকে তিনি যুক্ত করেছিলেন। কারণ, বিজ্ঞানমনস্কতা মানুষের অন্তরকে স্বচ্ছ করে।
তিনি একবার বলেছিলেন, “মানুষের উপর দেবতার ভর হওয়া, এই ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করিনা। এগুলোর পিছনে উদ্দেশ্য থাকে, অনেক সময়, মৃগি রোগের শিকার হওয়া কোন রমনীকে বিশেষ উদ্দেশ্যে ভর হয়েছে বলে প্রচার করে, সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে অনেক অসাধু কাজ করা হয়।“
বিশ্বাসভঙ্গ পাপ বলে তিনি মনে করতেন।
আবার কারোর বিশ্বাসে আঘাত করারও পক্ষপাতি ছিলেন না বাবাজী মহারাজ। তাই সকলকে বলতেন, প্রত্যকের গুরুই তার কাছে শ্রেষ্ঠ। কারো ধর্ম ও গুরুদেবকে অসম্মান করাউচিত নয়।
আগামিকাল