যেমন দেখেছি তাঁরে
তারক ঘোষ
পর্ব ৩২
আজ স্বমী বিবেকানন্দের জন্মদিন। বাবাজী মহারাজের এক আদর্শ ছিল স্বামীজীর বাণী ও তার জীবন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা কুসংষ্কারের বিরুদ্ধে যেমন স্বামীজী সুদৃঢ় অবস্থা নিয়েছিলেন, বাবাজী মাহারাজও সেই মার্গেই বিশ্বাসী ছিলেন। তার কথায় বহুবার উঠে এসেছে বিভিন্ন মেলায় নানা কুসংষ্কারের বলি হওয়া মানুষের করুণ কাহিনী।
সাগরদ্বীপ থেকে আমাদের সংবাদ ভয়েস ৯ এর প্রতিনিধি রজত রায় গতকাল একটা কথা বলেছিল – ধর্ম নয়, এ যেন জীবনের মেলা। এক খোঁজ। জীবনভর যে খোঁজ চলে। সেই খোঁজের টানেই গঙ্গাসাগরে আসছেন লক্ষ লক্ষ ভক্ত আর সাধু-সন্ন্যাসীর দল। কিন্তু কী সেই খোঁজ?
রজত কথা বলেছিলেন বহু পূণ্যকামী তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে। অনেকেই তাকে বলেছিলেন – শান্তি।
এই শান্তির সন্ধানেই আশ্রমে আসেন বহু মানুষ। জীবনের তাপে পুড়তে পুড়তে তাদের মনে হয়- একটু শান্তি চাই। কোথা গেলে তারে পাই?
বাবাজীর কাছে নানা শ্রেণির মানুষ আসতেন – ধনী-দরিদ্র, বিভিন্ন পেশার মানুষ। বাবাজীর কাছে মন্ত্র-দীক্ষা নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতেন। বাবা বলতেন, মনটাকে আগে তৈরি কর। ভেবে দেখ, পারবি কি না। তারপর আসিস। মন্ত্র দেওয়াটা ব্যাপার নয়, জীবনভর পালন করে যাওয়াটাই ব্যাপার। আর একটি কথা তিনি বলতেন তা হল- লক্ষ্য স্থির রেখে চলা।
কলকাতার একটি ইংরাজী কাগজের প্রতিনিধি হিসাবে আমি প্রয়াগের কুম্ভ মেলা কভার করতে গিয়েছিলাম বহু বছর আগে। দেখেছিলাম, সেই একই আকুতি। ত্রিবেণী সঙ্গমে আসা মানুষের হাহাকার, যন্ত্রণা আর আনন্দের অভিব্যক্তি।
সেই মেলায় রামভজন যাদব নামে এক দেহাতি মানুষের পরিচয় হয়েছিল। তিনি এসেছিলেন তার পঙ্গু বোনকে নিয়ে। মনে আশা, ত্রিবেণী সঙ্গমের পূণ্যস্নানে তার বোন আবার চলতে পারবে। হ্যা, আশা। এই আশা নিয়েই ভারতের পূণ্যকামী মানুষেরা বেঁচে থাকেন। তারা বিশ্বাস করেন, মাথার উপর এমন একজন আছেন, যিনি সর্ব বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করবেন। তাদের এই আশা আর বিশ্বাসই তাদের জীবন-যুদ্ধে লড়াই করার শক্তি যোগায়।
আশ্রমে এসে সেটা দেখেছি। মাথার উপর সদগুরুরূপী বাবাজী আছেন, ভয় কী!
কিন্তু বাবাজী বলতেন, আশ্রমে শান্তি পাওয়া যায় না, শান্তি পাওয়া যায় ভগবানকে জানতে পারলেই। আর সে জন্য আত্মাকে জানতে হবে। আর এই আত্মাকে জানতে হলে প্রথমেই ঠিক করতে হবে লক্ষ্য। আর লক্ষ্য ঠিক রেখে এগোলেই দেখতে পাবি, তোর কর্ম ঠিক আছে।
বাবাজী মহারাজের একটা কুসংষ্কারবিরোধী মন ছিল, আর এটা তিনি পেয়েছিলেন তার শ্রীগুরু স্বামী জানকীদাসজীর কাছ থেকেই। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, অনেকে বিশ্বাস করেন, কারো কারো মুখদর্শন কর্মে বাধার সৃষ্টি করে। কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির মুখ দেখে গেলে নাকি বাধা আসে।
এই প্রসঙ্গে বাবাজী বলতেন, এটা একটা অন্ধ-বিশ্বাস। যারা মনে করেন, অমুক ব্যক্তির মুখ-দর্শন করাতেই তার বিপদ হল। অন্যদিকে, সেই ‘অমুক’ ব্যক্তিটিও ভাবতে পারেন, ‘তমুক’ ব্যক্তির মুখোমুখী হওয়াতেই তার কার্যসিদ্ধি হল না। এই প্রসঙ্গে স্বামী জানকীদাসজীর প্রসঙ্গ টেনে বাবাজী বলতেন – বাবা বলতেন, ‘কারো মুখ দেখা পাপ, এই কথাটা কুসংষ্কার। এটা সামাজিক অন্যায়।‘
বাবাজী বলতেন, সমাজ থেকে এই দুষ্ট ক্ষতকে মুছে ফেলতে হবে, নইলে আসল ধর্মটাই চাপা পড়ে যাবে আর আমরা মেতে থাকব অন্ধ-বিশ্বাস নিয়ে। বিশ্বাস মানুষের উন্নতি করে যতটা, অন্ধ-বিশ্বাস আর কুসংষ্কার ক্ষতি করে তার চেয়েও বেশি।‘
বাবাজী বলতেন, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে ভোগ, তার শুরু ও শেষ আছে, তাই এই ইন্দ্রিয়ভোগের দ্বারা মানুষের জীবনে কখনোই শান্তি আসতে পারে না। ভোগ করতে করতে, একটা সময় আসবে হতাশা। আর এই হতাশা থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজতেই তখন মানুষকে ফিরতে হবে সেই সুপ্রাচীন পথে, যে পথ আমাদের নিয়ে যাবে পরমশান্তির দিকে।
জপ, ধ্যান ধর্মীয় ব্যাপার শুধু নয় এর মধ্যে আছে বিজ্ঞান। আর জপ ও ধ্যানের মাধ্যমে মানুষ খুঁজে পাবে জীবনের পরম শান্তি। তিনি একইসঙ্গে আর একটি কথা বলতেন। তা হল – পরের জন্য বাঁচা, নিজেকে তার জন্য প্রস্তুত করা আর নিঃষ্কাম কর্ম করে যাওয়া।
তিনি বলতেন, নেতাজী, স্বামীজী, এপিজে আব্দুল কালাম, বালগঙ্গাধর তিলকের জীবন ও বাণী মানুষকে পথ দেখাতে পারে। তারা যে আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, আমরা কোথাও না কোথাও সেই আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আর এই দূরে সরতে সরতে আমরা চলে যাচ্ছি ঈশ্বরের কাছ থেকে, মুক্তি থেকে অনেক দূরে। ওই সমস্ত মহামানবরা আমাদের দিয়ে গেছেন প্রকৃত ভারতীয় আদর্শ, কুসংষ্কারবিরোধীতা আর সংযমের শিক্ষা।
তিনি মিডিয়ার ভূমিকা তুলে বলেছিলেন – সমাজ গঠনে যুবসমাজ আর মিডিয়াকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন ভারত গড়তে হলে দূর করতে হবে অন্ধ-ধর্মীয় বিশ্বাস। মিডিয়ার কাজ শুধু অর্থ উপার্জন নয়, সমাজ গঠন করাও তাদের একটা কাজ।
এই প্রসঙ্গে তিনি বহুবার রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ নাটকের প্রসঙ্গ তুলেছেন। গুরু কেমন হবে, কে গুরু? এই নিয়ে অনেক কথা বলেছেন।
তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন – “আমরা সহজে গুরু হয়ে যাচ্ছি। ফলে আমাদের কথার গুরুত্ব কমছে। এই প্রসঙ্গে তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা তুলে বলেছিলেন – শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, সাধু হল বারুদ ভরা গুলি আর গৃহস্থ হল ফাকা গুলি। কাজেই সাধু যদি আধ্যাত্মিকতায় ধনী না হয়, তাহলে তো সমাজ পরিবর্তন করতে পারবেন না। আমরা যেন নিজেদের যোগ্য করে তুলেই আপনাদের সামনে আসতে পারি।‘
চলবে