তারক ঘোষ
পর্ব ৪৩
আজ থেকে থেকে ঠিক ৯ বছর আগে, এই মাসেই শ্রীগুরুদেবের পার্থিব জীবনের সমাপ্তি ঘটে। শেষ হয় তার আপাত-কর্মময় জীবনের, কিন্তু মহামানবদের জীবনের লীলা শেষ হয় ঠিকই, কিন্তু তাদের আর পাঁচটা মানুষের মতো পরিসমাপ্তি ঘটে না। তারা বেঁচে থাকেন তাদের রেখে যাওয়া গৌরবময় কর্মের মধ্যে, তাদের দর্শন আর সৃষ্টির মধ্যে।
আমাদের বাবাজী মহারাজও তাই রয়ে গেছেন আমাদের মাঝেই।
কিন্তু, তার এই থাকা, আর না থাকা, এটা একেকজন ভক্তের কাছে এক একরকম। কেউ ভাবেন, বাবাজী নেই, তারা শোক করেন। তার মৃত্যুতিথি পালন করেন। আবার কেউ মনে করেন, তিনি আছেন সবসময়। তারা শোক করেন না, শুধু একমনে তার রেখে যাওয়া আদর্শকে অনুসরণ করে চলেন।
আমার মতে, আমরা যদি তাকে মনে রাখি, তার দেখানো পথ অনুসরণ করি, তাহলে তিনি আছেন। তার মৃত্যু নেই। তিনি অমর। পৃথিবীর নিয়মে পার্থিব শরীর ছাড়লেও, তিনি রয়ে গেছেন এই পৃথিবীর গাছে-পাতায়-জীবনের রঙে। তিনি বেদনায় থাকেন না, তিনি আনন্দস্বরূপ।
বাবাজী তার সাধু-শিষ্য ও গৃহী-শিষ্যদের জন্য অনেক কিছু রেখে গেছেন। আমি পার্থিব সম্পদের কথা বলছি না। যে সম্পদ অক্ষয়-অমর-যা দান করলে বাড়ে – সেই সম্পদের কথাই বলছি। সেটা হলো –জ্ঞান, চেতনা। নিজেদের চিনে নেওয়ার মন্ত্র।
আমরা তার দেওয়া মন্ত্র জপ করি ঠিকই, পাশাপাশি, যে অমূল্য মন্ত্র আমাদের তিনি দিয়ে গেছেন তার কর্মের মাধ্যমে, সে কথা আমরা ক’জন মনে রাখি!
প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি কী রেখে গেলেন আমাদের জন্য?
আমার মনে হয়, এর উত্তর হওয়া উচিত – ত্যাগের আদর্শ আর কর্মে লিপ্ত থেকেও কর্মে আসক্তি না থাকা। একজন প্রকৃত সন্ন্যাসীর যা আদর্শ হওয়া উচিত, তারই দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন।
একবার ভাবুন তো, যিনি শিক্ষার শেষ স্তরে পৌছেও, ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেও তা কাজে লাগাননি অর্থ উপার্জনের জন্য। আমি বলতে চাইছি, ওই ডিগ্রিকে কাজে লাগিয়ে তিনি হতে পারতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। উপার্জন করতে পারতেন প্রচুর অর্থ, সেটা কাজে লাগাতে পারতেন, নিজের সন্তুষ্টির পিছনে। এক নিশ্চিন্ত, নিরুপদ্রব জীবন লাভ করতেন, এমনকি তাকে হয়তো অসময়ে চলে যেতেও হত না। তাহলে করলেন না কেন?
কারণ, তার কর্মে আসক্তি ছিল, কর্মফলে নয়। তিনি আমাদের গীতার বাণী শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছিলেন। দিয়ে গেলেন আর এক অমূল্য গীতা। চেতনা, নির্লিপ্ত থাকার উদাহরণ, বিবেক, মানবিকতা আর লোভ জয় করার মূলমন্ত্র।
আমরা শিখলাম কি?
সবাই শিখি নি।
কারণ, আমরা তার বাইরের রূপে আকৃষ্ট ছিলাম, তাই তার অন্তরের দিকে তাকাই নি।
দু-কান ভরে তার অমূল্য কথাই শুনে গেছি, পালন করার কথা মনে হলেও, পালন করতে পারিনি। সংসার হয়তো পালন করতে দেয় নি, কিংবা সংসারের দোহাই দিয়ে আমরাই ফিরে গেছি নিজেদের বলয়ে। বেরিয়ে আসার কথা ভাবতেই ভয় হয়েছে।
'আমরা তো সাধু নই, ওসব সাধুদের জন্য' – এই বাক্য ভেবে নিজেদের শান্তনা দিয়েছি।
'কর্ম করব, কর্মফল নেবো না? তাহলে সারা মাস ধরে খেটে, মাইনে নেব না?'
এইরকম যুক্তিও কর্ম আর কর্মফলের উদাহরণ হিসাবে অনেকে দেখান।
'ছেলেকে মানুষ করলাম, এখন বুড়ো বয়সে সে কেন দেখবে না? খেটে সম্পত্তি করলাম, তাহলে ভোগ কি অন্য লোকে করবে' – এরকম অজস্র হাস্যকর যুক্তি।
শ্রীবাবাজী বা শ্রীগীতা আমাদের এই কর্ম ও কর্মফলের কথা বলেন নি। তারা যে কর্মের কথা বলেছেন, তা হল – যে কর্ম করলে আর ফল লাভের কথাই মনের মধ্যে জাগবে না, সেই কর্ম।
যে কর্ম করলে, ভগবান সন্তুষ্ট থাকেন, সেই কর্ম। যে কর্ম করলে, আপনি সুখে নিদ্রা যেতে পারেন সেই কর্ম।
কবিগুরু বলে গেছেন –
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।“
পরের মঙ্গলের জন্য কর্ম করুন, ঈশ্বরের কর্ম করছি ভেবে- দেখবেন, ফলের কথা মনেই আসবে না। ছেলেকে মানুষ করুন, কর্তব্য হিসাবে, ইনভেস্ট হিসাবে নয়।
দেখবেন, ছেলে দেখলো না বলে, মনে কষ্ট আসবে না।
পাওয়ার আশা থেকে যে কর্ম, সেই কর্মই আপনাকে দুঃখ দেবে।
আর পাওয়ার আশা না করে যে কর্ম করবেন, সেই কর্ম আপনাকে মানসিক শান্তি দেবে।
শ্রীবাবাজী আমাদের সেই কর্মপথের সন্ধান দিয়ে গেছেন। সেই পথে আমরা চলতে পারিনি। পরালোচনা নিয়ে, পরের দোষ খুঁজতে খুঁজতে কাটিয়ে দিয়েছি অর্ধেক জীবন।
চলবে