বাবাজী মহারাজ কি সারা জীবন ‘বেনা-বনে মুক্তো ছড়িয়ে’ গেলেন?


কাঠকে যেমন চুম্বকে পরিণত করা যায় না, তেমনি সব অন্তরে তৈরি হয় না প্রকৃত গুরু-ভক্তি। একটা বাহ্যিক ভক্তি থাকে। সেটা অনেকটা রুটিন ওয়ার্কের মতো। ভাবের গভীরতাও থাকে না, থাকে না দায়িত্ব নেওয়া বা পালনের মতো কঠিন কাজ।

তারক ঘোষ 

পর্ব ৪৪ 

 উপরের কথাটি একান্তই আমার উপলব্ধি। কেন এই কথা বললাম, তার পিছনে যুক্তি আছে, আছে উদাহরণ। আছে কিছু বিশেষ ব্যাখ্যা। সে সব কথায় যাওয়ার আগে বেশ কয়েকটা কথা বলার আছে। প্রথম কথা হল, বাবাজীর জীবনটা ছিল শ্রীগীতার আলোকে উদ্ভাসিত। 
কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, সন্ন্যাসযোগ, ভক্তিযোগ, ধ্যানযোগ, জ্ঞনান-বিজ্ঞানযোগ তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। 
বাবাজীকে দেখার আগে, আমি যে সন্ন্যাসীদের দেখেছিলাম, তাদের বেশিরভাগটাই ছিলেন আশ্রমের গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কেউ বা বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক-বিহীন। কেউ, আশ্রমের পরিধি বিস্তার আর শিষ্য-সংখ্যা নিয়েই ব্যস্ত। 
বাইরে সন্ন্যাসী, ভিতর ছুটে বেড়াচ্ছে অর্থের পিছনে। পরমার্থ রয়েছে বহু পিছনে পড়ে। এদের দেখলে মনে হত না, সমাজ থেকে নিলেও, সমাজের প্রতি তাদের কোন দায়িত্ব আছে কি না। না, মানুষের অন্তর, না মানুষের বাহির, কোনটাকেই এরা পরিবর্তন করতে পারেন নি। আমি আবার বলছি, আমি সবাইকে এর মধ্যে ধরছি না। 
 কিন্তু, আমাদের বাবাজী ছিলেন, এমন এক ঋষি, যিনি জগতকেও অস্বীকার করেন নি, তেমনই ঈশ্বরকে। অর্থ ফেলে মানুষকে পরমার্থ দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। আর সেই পরমার্থ দেওয়ার জন্য তাদের বাহ্যিক উন্নতির ব্যবস্থাও করছিলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। আর ধর্ম করতে গেলে কর্ম ত্যাগ করা যায় না, উচিতও নয়। ধর্মের সংষ্কার আর সেই ধর্মের সঙ্গে কর্মকে যোগ করে তিনি প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন কর্মযোগী এক সন্ন্যাসী ও সমাজসংষ্কারক। সমাজের মানুষের মধ্যে ধর্মের বীজ বুনতে গেলে যে জমি তৈরির প্রয়োজন, সেটা তিনি বুঝতেন। 
এখন, কজন সন্ন্যাসী আছেন, যারা নিজেদের উন্নতি না ভেবে, মানুষের আধ্ম্যাতিক ও সামাজিক উন্নতির জন্য নিজের জীবনকে ব্যয় করে ফেলেন?
 তবু, এখন, বাবা পার্থিব জগত ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মনে হয়, তিনি কি সারাজীবন বেণাবনে মুক্তো ছড়িয়ে গেলেন! এমন কেউ কি নেই, যিনি বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো করতে পারেন? তার বাণীকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন? 
যিনি শুধু অর্থের জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে না বেড়িয়ে তার আদর্শ প্রচারের জন্য, মানুষের সামাজিক ও আত্মিক সংষ্কারের জন্য কাজ করবেন। অনেকের মুখ মনে পড়ে। তখনকার আর এখনকার। সবাই শুধু নিতে আসে, হাতে গোনা কয়েকজন দেওয়ার কথা ভাবেন। আজ নতুনগ্রামের বুকে যেটুকু উন্নতি হয়েছে বাবা থাকাকালীন। তারপর?
শুধু শূন্যতা। বাবাজীর স্বপ্ন ছিল, গ্রামের গরীব মানুষগুলো যাতে ভালো চিকিতসার সুযোগ পান। তাই ভেবেছিলেন বিনামূল্যের একটা হাসপাতাল তৈরি করার কথা। 
কিন্তু, তার সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ পাওয়ার আগেই তাকে চলে যেতে হল। অসম্পূর্ণ রইল হাসপাতাল সহ আরো বেশ কয়েকটা কাজ। আর এই কাজগুলো সবই ছিল মানুষের জন্যই। স্বামীজীর মতোই, তিনি জীবের মধ্যেই ভগবানকে পর্যবেক্ষণ করতেন। 
 এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলতে চাই, গুরু যখন শিষ্যকে চালিত করেন, তখন তিনি তাকে সঠিক পথেই নিয়ে যান। আর শিষ্য যখন গুরুকে চালিত করার চেষ্টা করেন, তখন সেটা গুরু ও নিজের উভয়ের ক্ষতির কারণ হয়। 
অনেকে বলেন, গুরুকৃপা হলে সব হয়ে যায়। মানছি। কিন্তু, আধার ঠিক না হলে, সেই কৃপা ধারণ করা সম্ভব হয় না। নিজেকে কৃপা লাভের উপযুক্ত করে তুলতে না পারলে গুরু-কৃপা আসে না।
আর নিজে নিজেকে সেই ভাবে তৈরি না করে, গুরুর কৃপার ভরসায় কাটিয়ে দিলে আমার মনে হয় কৃপা আসবে না। কারণ, শিক্ষকের কাছে সব ছাত্র সমান মনে হলেও, তিনি সেই ছাত্রকেই অগ্রাধিকার দেবেন, যে ভালো ছাত্র। 
শিক্ষকের প্রতি বাস্তব শ্রদ্ধা, শিক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতা, নিষ্ঠা , পরিশ্রম আর ঐকান্তিকতা। যে ছাত্রের মধ্যে গুণগুলো থাকে, শিক্ষক তার প্রতি বিশেষ ভাব রাখেন। তার শিক্ষকের দেওয়া শিক্ষাকে যে কোন মূল্য দেয় না, সে শিক্ষকের কৃপালাভে বঞ্চিত হয়।
 আর তা সত্বেও যদি শিক্ষক তার প্রতি সমদৃষ্টি রাখেন, তাহলে সেটা বেনা-বনে মুক্তো ছড়ানো হয়ে যায়। কাঠকে যেমন চুম্বকে পরিণত করা যায় না, তেমনি সব অন্তরে তৈরি হয় না প্রকৃত গুরু-ভক্তি। একটা বাহ্যিক ভক্তি থাকে। 
সেটা অনেকটা রুটিন ওয়ার্কের মতো। ভাবের গভীরতাও থাকে না, থাকে না দায়িত্ব নেওয়া বা পালনের মতো কঠিন কাজ। ধর্মের উপদেশ দেওয়া সহজ। কিন্তু, বাস্তবের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষের সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ ক’জন গুরু করতে পারেন?
 শিষ্য শুধু দেওয়ার জন্য নয়, নেওয়ার জন্য। সবাই ছেলেমেয়েকে পড়তে দেওয়ার সময় ভালো জ্ঞানী শিক্ষক খোজেন। কারণ, তারা জানেন, যে শিক্ষকের শিক্ষা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই, তিনি ছাত্র-ছাত্রীকে প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারবেন না, দেওয়া সম্ভব নয়। যিনি, নিজেই উত্তর খুজে পান নি, তিনি ছাত্রের উত্তর দেবেন কীভাবে?
বাবাজী তাই ধর্মের সঙ্গে কর্মের মেলবন্ধনকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
 তিনি তার লেখা ‘গীতা চিরন্তন’ গ্রন্থের কর্মযোগ পর্বে একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন – ভাবুকতার আশ্রয় নিয়ে কর্তব্য-কর্মে তাচ্ছিল্য বোধ এলে তমোগুণ সাধকের সর্বনাশ করে ছাড়ে। তাই ভালো না লাগলেও কর্তব্য-কর্মে লেগে থাকতে হয়।
 এই প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন - “বাবাজী (স্বামী জানকীদাস কাঠিয়া মহারাজ) বলতেন –‘কর্তব্য সর্বদা নীরসই হয়। তা না হলে বাইরে সাধু সাজা যাবে এবং কিছুদিন জগতে পুজোও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সাধকের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে অন্তর পাপময় হয়ে যায়। অলসতা-বশতঃ কর্ম ত্যাগ করলে শ্রীভিগবান লাভ তো হবেই না, পরন্তু,শরীর অকেজো হয়ে ব্যাধির বাসস্থান হবে।“ 
চলবে

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad