সমষ্টি নয়, নিছক ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যে কর্ম, সেটা সেবা নয়; তবে পরিষেবা বলতে পারেন।

তারক ঘোষ
 পর্ব ৪৫ 

 প্রথমেই ’সংবাদ ভয়েস ৯’ এর দেশ-বিদেশের লক্ষাধিক পাঠককে আমার প্রণাম জানাই। যারা না থাকলে, ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল সংবাদপত্র হিসাবে ‘সংবাদ ভয়েস ৯’ উইকিপিডিয়ায় এনলিস্টেড হত না। বাবাজীর আশির্বাদ আর পাঠকদের ভালোবাসা না থাকলে ‘সংবাদ ভয়েস ৯’ মাত্র ৯ মাসে এই স্থানে আসতে পারত না। আমাদের পাঠকদের আর একটি জানানোর বিষয় আছে, সেটি হল, আমরা চলতি বছরেই আপনাদের বসার ঘরে আসতে চলেছি আমাদের নিউজ টিভি নিয়ে। 

বার আজকের বিষয়ে আসি। গতকাল “বাবাজী মহারাজ কি সারা জীবন ‘বেণা বনে মুক্তো ছড়িয়ে’ গেলেন?”– শিরোনামে লেখা আমার প্রবন্ধ সম্পর্কে এক ভদ্রলোক কিছু প্রশ্ন তোলেন, তার উত্তর আমি দিয়েছি।
 কিন্তু, সেই প্রসঙ্গ টেনে সকলের অবগতির জন্য দুটি কথা জানাই – ভারতের সংবিধান আমাদের বাক স্বাধীনতা দিয়েছে, আমাদের সমালোচনা করার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু, তার মানে এই নয়, আমরা এই বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অন্য কারো ব্যক্তি-স্বাধীনতা হরণ করব, বা তার সম্মানহানি করব – সেটা ভারতের আইন সমর্থন করে না। 
আর সেই কাজের সমালোচনা করা যায়, যেখানে জনগণের অর্থ বা জনগণের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তাই আমরা সরকারের সমালোচনা যেমন করতে পারি।
তেমনই কোন প্রতিষ্ঠান (যেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগণের অর্থ যুক্ত হয়েছে), সেই প্রতিষ্ঠান যদি এমন কিছু কাজ করে, যা জনগণের বা সমাজের বিপক্ষে যায়, বা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী হয় – তার সমালোচনা করা যেতে পারে। 
কোন মানুষ, তিনি ভাল কাজ করবেন কি, করবেন না, তার সমালোচনা করতে পারি না। যেটা করতে পারি, সেটা হল আত্মসমালোচনা। আমরা অন্যকে আহ্বান জানাতে পারি, কোন ভাল কাজ করার জন্য। গুরুর আদর্শ ফুটে ওঠে এরকম কর্ম করার জন্য আমরা বলতে পারি, “এমন কেউ কি নেই, যিনি বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো করতে পারেন? তার বাণীকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন?” 
গতকাল, এই অংশটি পরার পর এক ব্যক্তি ফেসবুকে আমাকে উদ্দেশ্য করে কমেন্ট করেন- “লেখাটা পরে একটু অবাক লাগলো। কোন কিছু সমালোচনা করা খুব সহজ। এরপর বলুন তো আমরা বাবার ভক্তদের মধ্যে ক’জন এগিয়ে এসেছি বাবার স্বপ্নকে স্বার্থ করতে। বাবার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কত সুন্দর হয়েছে। দেখলে মন ভরে যায়। এর পিছনে যিনি কাজ করে যাচ্ছেন তিনি আমাদের সকলের অতি প্রিয়।“
ওনার এই কথার উত্তর আমি দিয়েছি। সেটা উনি জানেন। 
কিন্তু, এই প্রসঙ্গে আর কিছু কথা বলার আছে। ছেলে-মেয়েদের ইংরাজী শিক্ষার প্রয়োজন আছে, আছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রয়োজন। সেটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। যেটা বলার – উনি এটাকে কেন আমি যে কর্মের কথা বলতে চেয়েছি, বা যে কর্ম করার জন্য আহ্বান করতে চেয়েছি, সেই কর্মের নিদর্শন হিসাবে দেখাতে গেলেন?” বুঝলাম না। 
আমার কথাটা ছিল, এমন কিছু করার জন্য এগিয়ে আসুন, যাতে গরীব মানুষরা উপকৃত হবেন। এমন একটা হাসপাতাল করা যেতে পারে, সেখানে বিনা পয়সায়, গ্রামের বা শহরের গরীব অসহায় মানুষেরা ভালো চিকিৎসা, ভালো পরীক্ষা বা ওষুধ পাবেন আর তা বিনামূল্যে। 
আর সেটা না হয়ে কেউ যদি একটা নার্সিং হোম তৈরি করেন বা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন, যেখানে টাকা না ফেললে, গরীব মানুষেরা চিকিৎসার সুযোগ পাবেন না, তাহলে সেটা কী সেবা হল? সেটাকে একটা ভালো পরিষেবা বলা যেতে পারে। 
আমি বলতে চাই, সমষ্টি নয়, নিছক ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যে কর্ম, সেটা সেবা নয়; তবে পরিষেবা বলতে পারেন। ব্যবসা আর সেবা – এই দুটোর মধ্যে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। 
এবার আসি আরেকটি কথায়। কেউ যদি, নিজের টাকা বিনিয়োগ করে, একটা বিরাট ইংরাজী মাধ্যম স্কুল তৈরি করে, সেখানে গরীব শিশুদের সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় ইংরাজী শিক্ষায় সুশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করেন, সেটা বলব, নিঃস্বার্থ কর্ম। 
বাবাজীর আদর্শ মানে, অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করা। যাদের দেওয়ার ক্ষমতা আছে, তারা যেখানে ইচ্ছা, সেখান থেকেই পরিষেবা নিতে পারেন। কিন্তু, গরীব মানুষেরা সেটা তা পারেন না। তাবলে কি তাদের ইচ্ছা থাকে না, সন্তানদের ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে পড়িয়ে সুশিক্ষিত করার? 
 আমি বলছি, থাকে- সব বাবা-মায়েরই থাকে। সামর্থ্যে কুলায় না। আমি এই অসহায় মানুষদের কথা বলতে চেয়েছি। এদের জন্য কিছু করার। 
আমি জানি না, ওই ভদ্রলোক যে স্কুলের কথা বলেছেন, সেই স্কুল অন্য হাজার হাজার ইংরাজী মাধ্যম স্কুলের মতো অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দেয়, না কি বিনা পয়সায়। যদি, সেখানকার নিয়ম ভারতে দিল্লি বোর্ড অনুমোদিত আর পাচটা স্কুলের মতো হয়। সেটা নিয়ে আমাদের কিছু বলার অধিকার নেই। যাদের টাকা আছে পড়াবেন। যাদের টাকা নেই পড়তে পাবেন না। এটা নতুন কোন বিষয় নয়।
জানি না ওই ভদ্রলোক, এই উপমা টেনে কী প্রমান করতে চাইলেন। পারলেন, না কি পরোক্ষে ওই “আমাদের সকলের অতি প্রিয়।“ ওই ব্যক্তিকেই অসম্মান করে ফেললেন? 
আমি আবারো বলি, আমি সমালোচনা করি না, আত্মসমালোচনা করি। আর যদি সমালোচনা করি, সেটা একজন সাংবাদিক হিসাবে। 
বাবার একজন ভক্ত হিসাবে, বাবার অন্য ভক্তদের কাজের সমালোচনা করার কোন অধিকার নেই। কারণ তিনি একজন ব্যক্তি মানুষ। তার মত ও পথ, তার নিজের। আমি আগেও যা বলেছি, আজো তাই বলে – বাবাজী ছিলেন কর্মযোগী। কর্মের মাধ্যমে ধর্মকে যুক্ত করে অননুকরণীয় সেবার আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, সময় পেলে আরো করতেন। তিনি সেবা-বুদ্ধিতে কর্ম করতেন। তার সেই সেবা-বুদ্ধির সঙ্গে আমরা যেন অন্য কর্মকে গুলিয়ে না ফেলি।
আমি জানি, তিনি কোন ধরণের ইংরাজী-মাধ্যম স্কুলের কথা বলেছিলেন। তবে, যে যাই করুন না কেন, সেটা করুন। কিন্তু, দয়া করে, সেবার সঙ্গে পরিষেবাকে গুলিয়ে ফেলবেন না। আমাদের এই দেশে, মহাপুরুষদের নামে মিষ্টির দোকানও আছে। সেখানে, কিন্তু কাউকে বিনা পয়সায় মিষ্ট খাওয়ানো হয় না। কিন্তু আশ্রমে খাওয়ানো হয়। কারণ, সেটা সেবা। এখানে হিসাব-নিকেশের ব্যাপার নেই।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad