তারক ঘোষ
“বিনা দুঃখে হয় না সাধন সেই যোগীজনার বাঞ্ছিত চরণ রে”
একদিকে অপার গুরুভক্তি, গুরুবাক্য নির্বিচারে পালন, লক্ষ্য স্থির রেখে কর্ম করে যাওয়া আর অন্যদিকে ধীরে ধীরে দুঃখ আর অপমানের আঁচে পুড়তে পুড়তে থাকা – এভাবেই সাধকদের জীবনে এসেছে পরমপ্রাপ্তি, পৌঁছাতে পেরেছেন তাদের লক্ষ্যভূমিতে।
শুধু সাধক নন, সাধারণ গৃহীরাও যখন অন্যায়ভাবে দুঃখ আর অপমান পেতে থাকেন, বুঝতে হবে, ভালো কিছু একটা আসছে।
বাবাজী মহারাজ লিখছেন –পরম্পরাগত শক্তি পূর্ববর্তী গুরু দ্বারা যে যোগ্য পাত্রে অভিষিক্ত হয়, সেই পাত্রে গুরুশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গুরুশক্তি ইট পাথরের দালান বা আশ্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা পুরুষানুক্রমিক।“
এই প্রসঙ্গে বাবাজী মহারাজ বলছেন - তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন অপাত্রে বিদ্যা না যায়। পুরুষের যোগ্যতাও প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ তিনি দিয়েছেন।
লন্ঠনের ফিতা ভালো জ্বললেও চিমনিটা যদি মলিন হয়, তাহলে ঘরটা ভালো আলোকিত হয় না।
বাবাজী মহারাজ লিখছেন- এই সংসারে যিনিই শ্রীভগবানকে লাভ করে ধন্য হয়েছেন, তাকে দুঃখের আঘাতে জর্জরিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতেই শ্রী ভগবানকে লাভ করতে হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে কবি লিখছেন- “দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?”
আর একটি গানে বলা হয়েছে –
“বিনা দুঃখে হয় না সাধন
সেই যোগীজনার বাঞ্ছিত চরণ রে”
জানা যায়, শ্রীসন্তদাসজীর প্রিয় ছিল এই ওই গানটি। বহু কষ্টে তবে বাঞ্ছিত ফল পাওয়া যায়। রেডিমেড পদে এসে বসে পড়লাম, সাধন-ভজন করলাম না, মানুষের মঙ্গল চাইলাম না। নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম সাপের ঝাঁপির মতো কামনার ঝাঁপি।
তিনি কিন্তু ঈশ্বর থেকে বহু দূরেই থাকেন।
এইজন্য বাবাজী বলতেন – গুরুপরম্পরা পেতে হলে পুরুষের যোগ্যতার প্রয়োজন হয়।
বাবাজী মহারাজ বলছেন – “শ্রীদাদাগুরুজী মহারাজ এবং শ্রীবাবাজী মহারাজ, কারোর জীবনে এই সত্যের ব্যতিক্রম হয়নি। শ্রীশ্রী সন্তদাসজীর বিরুদ্ধে রটনা হয়েছিল, তিনি কাঠিয়াবাবার সমস্ত টাকা আত্মসাত করেছেন। (পত্রাবলী ৩ খন্ড)। তার গৃহী গুরুভাই সারদাপ্রসন্ন দাস এবং সাধু গুরুভাই বিষ্ণুদাসজীর (শ্রীপ্রজ্ঞাদাসজী মহারাজের শিষ্য বিষ্ণুদাসজী নন) সঙ্গে বিবাদ হয়। তবুও, ওই মহাপুরুষরা কারো সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন নি।
বাবাজী মহারাজের লেখা থেকে জানা যায় – “আশ্রম পরিচালনায় গৃহীলোকের হস্তক্ষেপে সাধু মহন্তের অসুবিধা হতে পারে। এর জন্য বোধহয় সেই ত্রিকালজ্ঞ ঋষি কমিটি করেন নি। শ্রীশ্রী সন্তদাসজী মহারাজের অনেক গৃহী শিষ্য বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়ে ১৯ মে তারিখে (সম্ভবতঃ ১৯১৫ সাল) তারিখে একটি সভা করেন। এরপর তাদের মধ্য থেকে ৫ জন সভ্য নির্বাচন করে আশ্রমের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটা কার্যকরী কমিটি গঠন করেন। কিন্তু, এই কমিটি গঠনের বিষময় ফল কিছুদিন পরেই ফলল।
আর এর ফলে শ্রীসন্তদাসজীর মতো মহাপুরুষদের মনে হয়েছিল – “কমিটি মহন্তকে একজন বেতনভূক কর্মচারী ছাড়া আর কিছু মনে করে না।“
বাবাজীর লেখা থেকে আমরা জানতে পারি –“শ্রীশ্রীদাদাগুরুজী মহারাজের সাধু শিষ্যদের মধ্যেও বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। যিনি বা যারা বয়স্ক, সাধুদের সম্মান দিতেন না।
শ্রীধরীটিকায় বলা হয়েছে –
“প্রমাদিনো বহিশ্চিত্তা, পিশুনাঃ কলহোৎসকাঃ।
সংন্যাসিনোহপি দৃশ্যন্তে দৈব সংদুষি তাশয়াঃ।।
এর অর্থ হল – প্রমাদী, বহির্মুখী, ঈর্ষান্বিত, কলহপ্রিয় ভাগ্যদোষে দুষ্ট সন্ন্যাসীও দেখা যায়। উপযুক্ত কর্মযোগ অবলম্বন না করে, কর্মযোগে যথাযথ পরিপক্ক না হয়ে, যারা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, অর্থাৎ ভিতরে আসক্তি থেকে যায়, সেই সন্ন্যাস দুঃখের কারণ হয়।
বাবাজী মহারাজ লিখছেন - আশ্রমের মধ্যে স্বামী ধনঞ্জয়দাসজীর বিরুদ্ধে একটি দল তৈরি হয়। এই দল কমিটির সভ্যদের কাছে শ্রীধনঞ্জয়দাসজীর বিরুদ্ধে রিপোর্ট পাঠাতে থাকে। ১৯৪৮ সালে আশ্রমের ভিতরের গন্ডগোল এরকম আকার ধারণ করল যে শ্রীশ্রীদাদাগুরুজী মহারাজ মহন্তের পদ ত্যাগ করবেন বলে ঠিক করলেন।
কমিটির কয়েকজন সদস্যকে তিনি বিতৃষ্ণায় পদত্যাগপত্র লিখে দিলেন। কিন্তু, মহারাজের গৃহীগুরুভাইরা এটা মেনে নিতে পারলেন না। তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় শেষপর্যন্ত শ্রীদাদাগুরুজীর পদত্যাগপত্র গৃহীত হল না।
চলবে…