সদগুরুর মধ্যে একইসঙ্গে তিনটি ভাব বিরাজ করে। শিষ্যভাব, জীবভাব ও গুরুভাব। একদিকে তিনি শিষ্যরূপে গুরুদেবের সেবা করেন অন্যদিকে গুরুরূপে শিষ্য গ্রহণ করেন। আবার জীবরূপে এই সংসারের যাবতীয় কর্ম করেন। শ্রী জানকীদাসজীর কথায়, মৃত্যুর পর শ্রীগুরুদেবের ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়, কারণ, তখন আর বন্ধন থাকে না।
শ্রীশ্রী জানকীদাসজী একটি চিঠিতে লিখছেন –“দেহধারী মহাপুরুষের গুরুভাব ও জীবভাব পাশাপাশিই থাকে। জীবভাবে তারা সাধারণ জীবের মতো কর্ম করেন। আবার পরমাত্মা ভাবে সর্বদা সাক্ষী স্বরূপ দ্রষ্টামাত্র থাকেন।“ শ্রীবাবাজী মহারাজের লেখা থেকে জানা যায়, শ্রীরামদাসজী কাঠিয়াবাবা একই দেহে দুটি সত্বার অবস্থান সম্পর্কে বলতেন – “হাথী কা দো দাঁত রহতা হ্যায়। এক, দেখানেকে লিয়ে, আউর এক খানেকে লিয়ে।“ আবার শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রভুর মধ্যেও দুটি ভাব দেখা যেত।
তিনি বলতেন –“আমি দুই অবস্থায় থাকি। কোন সময় সমস্ত ব্রম্ভ আমার চোখে ভাসে। আবার কোন সময় আমার আসনের নীচে কী আছে, তা বলতে পারি না।“
বাবাজী মহারাজ বলেছেন তার শ্রীগুরুদেব অর্থাৎ শ্রীজানকীদাসজীর মধ্যেও এই দুই ভাব ছিল। তিনি এই প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন।
“
একবার বাবাজী মহারাজ (শ্রীজানকীদাসজী) কলকাতায় একজনের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেইসময় এক ভদ্রমহিলা এসে বাবাকে বলেন – ‘মহারাজজী, আমার ছেলে যেন পরীক্ষায় পাশ করে।“ ওই ভদ্রমহিলার একান্ত প্রার্থনায় বাবা বললেন – ‘হ্যাঁ, পাশ করবে। কালীঘাটের মা কালীকে যেন প্রণাম করে যায়।‘
ওই ভদ্রমহিলা যখন বাবার কাছে এই কথা নিবেদন করছিলেন, তখন পাশ থেকে আর এক ভদ্রমহিলা তা শুনে বাবার কাছে গিয়ে মিনতি করেন, তার ছেলেও যেন পাশ করে যায়।
বাবা বললেন, ওসব কথা আমি বলতে পারি না। ভদ্রমহিলা নাছোড়বান্দা। তিনি বললেন, ‘আমি শুনলাম, আপনি বললেন ওর ছেলে পাশ করে যাবে।‘
বাবা বললেন, ‘আমি বলিনি, আমার শ্রীগুরুদেব আমার ভিতর দিয়ে ওকে ওই কথা বলেছিলেন।‘ ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি ওসব বুঝিনা, আপনি শুধু বলে দিন, আমার ছেলে পাশ করবে।‘
বাবা বাধ্য হয়ে ওই ভদ্রমহিলাকে বললেন, ‘আপনি যখন আমার কথা মানছেন না, তখন বলছি, আপনার ছেলে পাশ করবে।‘
পরে দেখা গিয়েছিল, প্রথম ভদ্রমহিলার ছেলে ভালোভাবে পাশ করেছিল আর দ্বিতীয় ভদ্রমহিলার ছেলে ফেল করেছিল।“
সবাই জানেন, শ্রীজানকীদাসজী বাকসিদ্ধ ছিলেন, তাহলে দ্বিতীয় ভদ্রমহিলার ক্ষেত্রে তার কথা খাটলো না কেন?
এই প্রসঙ্গে স্বয়ং শ্রীজানকীদাসজী বলেছেন – গুরুকে দিয়ে জোর করে কিছু বলিয়ে নিতে নেই, কোন কাজ জোর করে করাতে নেই। এতে শিষ্যের বা যিনি করাচ্ছেন, তারই ক্ষতি হয়। মহাপুরুষরা অন্তর থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যেটা বলেন, সেটাই সত্য হয়।
ব্যক্তিস্বার্থের জন্য জোর করে শ্রীগুরুকে দিয়ে কিছু বলাতে গেলে ভগবান তার উপর রুষ্ট হন।
এই প্রসঙ্গে তিনি সুন্দর একটি উপমা দিয়ে বলেছিলেন - গোরুর কাছে কসাই হয়ে ছুরি হাতে গেলে দুধ পাওয়া যায় না। বাছুর সেজে যেতে হয়। ভক্তের কাছে ভগবান ধরা দেবেনই। কিন্তু ধরতে জানা চাই। মনের মধ্যে অহঙ্কার থাকলে ভগবান দূরে চলে যান।
ঠিক তেমনই, শ্রীগুরু কাছের থেকেও কাছে, আবার দূরের থেকেও দূরে।
গুরুদেবরা যখন গুরুসত্তায় থাকেন, তখন, অন্য গুরুর সঙ্গে তাদের কোন প্রভেদ থাকে না। শ্রীধনঞ্জয়দাসজী তার শিষ্যদের কাছে বলেছিলেন – ‘এ বড় কঠিন ঠাই, গুরু-শিষ্যে ভেদ নাই।‘
আমাদের বাবাজী মহারাজ লিখছেন – ‘স্বয়ং ভগবান ভক্ত সেজে কীভাবে পুজো করতে হয়, আমাদের শেখান। শ্রীবাবাজী (শ্রীজানকীদাসজী) মহারাজ যখন গুরুর গদিতে বসে শিষ্যদের পুজো নেন, তখন তিনি গুরু জানকীদাস। আবার যখন গুরুকে পুজো করছেন, তখন শিষ্য জানকীদাস।‘
বাবাজী মহারাজ বলতেন, সদগুরুর শিষ্য হল ছিপে গাঁথা মাছ। সদগুরু যখন একবার শিষ্যকে আশ্রয় দেন, তখন তিনি তাকে কখনো পরিত্যাগ করেন না।
শ্রীরামদাসজী কাঠিয়াবাবা বলতেন –‘চিন্তা মাত করো। হাম তুমকো খিঁচকে বৈকুন্ঠ লে যায়েঙ্গে। জানো, তুমহারা গুরু বড়া সামর্থী হ্যায়।“
বাবাজী বলেছেন, শ্রীশ্রীজানকদাসজী বলতেন – আমার প্রতিটি শিষ্যই আমার দেহের এক একটি রক্তবিন্দু। দেহত্যাগের পর আমার শক্তি আরো বেড়ে যাবে। দেহের বন্ধনে শক্তি স্তব্ধ থাকে, মৃত্যুতে দেহ মুক্তি ঘটলে, বন্ধন না থাকায় ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়।