নিঃস্বার্থ ত্যাগ জন্ম দেয় বৈরাগ্যের। লোভ, কামনা, পরশ্রীকাতরতা আর ক্রোধ – প্রাথমিকভাবে এই ৪ টি খারাপ বিষয়কে ত্যাগ করতে পারলে, মানুষ ভগবানের পথে পৌঁছে যেতে পারবেন।
ঈশ্বর যেমন সত্য, তেমনই এই জগতটাও সত্য। কাউকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের সংসার যেমন পিতা-মাতা-পুত্র-কন্যা নিয়ে, ভগবানের সংসারও তেমনই আমাদের ও এই জগতের গাছপালা-পশুপাখি-আলো-বাতাস নিয়ে। বাবাজীর ঘর। এখন যেমন। এই ঘর থেকেই তিনি শেষবারের মতো বেরিয়েছিলেন
তিনিই আমাদের সংসারের কর্তা। তিনিই আমাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি জুটিয়ে দেন বলেই, আমরা পাই। তিনি না জোটালে আমরা পাই না। ভগবানের এই সংসারে সবকিছু চলে নিয়মে, বেনিয়ম নেই। শুধু মানুষ বেনিয়ম করে বলেই ভগবান রুষ্ট হন।
কিন্তু, তিনি আমাদের ক্ষতি চান না, শুধু চান ভুল পথে গেলে আমরা যেন আমাদের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসি ন্যায়ের পথে, তাই সাময়িক শাস্তি দেন। এই শাস্তিটাও তার ভালোবাসা। কারণ, এইভাবেই আমরা চিনতে পারি নিজেকে। পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মীভূত হতে পারি।
আমি অনেককে বাবাজী মহারাজের কাছে বলতে শুনেছি – ‘সংসারে আর মন লাগছে না। বড় অশান্তি। ছেলে-বৌমা, দিনরাত অশান্তি। ইচ্ছে হচ্ছে সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে বনে পালাই।‘
বাবাজী এরকম কথা শুনে মৃদু হাসতেন।
আবার অনেকে বলতেন – ‘ছেলের এখনো চাকরি হলো না, মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। কী অশান্তি। টেকা যায় না।‘
কেউ বলতেন – ‘বাবা, কিছুতেই উন্নতি হচ্ছে না। এত জপ-ধ্যান করছি, অবস্থা যা ছিল, তাই আছে।‘ বাবাজী বলতেন – সংসারে কারো উপর অভিমান রাখতে নেই আর কারো দোষ দর্শন করতে নেই। যেটা করতে হয়, সেটা হলো আত্মসমালোচনা।
‘আমি কেন এই ফল পাচ্ছি? কেনই বা শুধু আমার সংসারে নিত্য অশান্তি? কেন আমার উন্নতি হচ্ছে না?’ এই সব প্রশ্নের উত্তর আপনার নিজের মনেই আছে। তাকে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে, যা ঘটছে, তার পিছনে আপনার কর্মের একটা যোগাযোগ আছে।
এই প্রসঙ্গে বাবাজী মহারাজ একটা গল্প বলেছিলেন – গল্পটি এরকম –
এক বৈশ্যকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল – এই সংসারে থেকেও আপনি কীভাবে আনন্দ-প্রাপ্ত হয়েছেন?
তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সংসারে থাকি কানার মতো, কালার মতো, বোবার মতো। আমি কিছু দেখেও দেখি না, শুনেও শুনি না, বোবার মতো শুধু নিজের কর্ম করে যাই। কারো প্রশংসাও করিনা, দোষও দেখি না। আমার কাছে এই সংসার মজার কুঠি।'
বাবাজী গীতার একটি শ্লোকের প্রসংগ ধরে বলছেন, “অনেকে সংসারের সমালোচনা করেন, একে সংসারের প্রতি বৈরাগ্য বলে না। রাবেয়ার কাছে এক ব্যক্তি এসে অনেকক্ষণ ধরে সংসারের নিন্দা করলেন। তার কথা শেষ হলে রাবেয়া বললেন – ‘আপনি সংসারকে ভালোবাসেন বলেই, সংসারের এত নিন্দা করলেন। আপনি যদি সংসারের প্রতি উদাসীন থাকতেন, তাহলে সংসারকে এত কটাক্ষ করতেন না। যে সংসারকে বেশি ভালোবাসে, সেই নিন্দা করে।“
আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন, এমন কিছু শাশুড়ী আছেন, যারা ঘরের বাইরে নানা জনের কাছে ছেলে-বৌ এর নিন্দা করে বেড়ান। এদের আপনি বলুন, ছেলে বৌ এর এতো যখন নিন্দা করছেন, তবে, তাদের টাকা-পয়সা না দিয়ে যারা আপনাকে ভালোবাসেন, তাদের দিতে পারেন। আপনার নিজের বাড়ি। সেখান থেকে ছেলে-বৌকে বের করে, যারা আপনাকে ভালোবাসে, তাদের থাকতে দিন।
দেখবেন চুপ করে যাবেন তিনি।
এই শ্রেণির মানুষজন সংসারের বা পরিবারের লোকজনদের নিন্দা করবেন, আবার সেখানেই থাকবেন। তাদের পাশেই থাকবেন। কিন্তু, সমালোচনা করতে ছাড়বেন না। আসলে, এদের সংসার বাইরে নয়, মনে।
তাই, এরা আশ্রমে এসেও সেই সংসারের কথা ভাবেন, সেই সংসারের নিন্দা করেন, আবার কীভাবে সেই সংসারের উন্নতি হবে, তার পথ-নির্দেশ চান শ্রীগুরুর কাছে।
সর্ব অবস্থায় যিনি স্থির থাকেন, সংসারের দায়িত্ব সামলেও যিনি সংসারের প্রতি উদাসীন থাকেন, যিনি সব কর্ম করেন ঈশ্বরের কাজ হিসাবে, সংসারের লাভক্ষতি, সুখ-দুঃখ যিনি গায়ে মাখেন না, যিনি নিন্দা বা প্রশংসাকে সমান জ্ঞান করতে পারেন, তিনিই সংসার জয়ী।
আর এর জন্য চাই মনের উপর নিয়ন্ত্রণ। মন, দেহের চালনা শক্তি। তাই মনের উপর নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে জরুরী।
কামনা আর কামনায় বাধা – এ থেকেই যত অশান্তি।
পরশ্রীকাতরতাও জন্ম দেয় কামনার। নারীকে ‘ভোগের বস্তু’ মনে করেন যারা, তারা কামনার কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। স্বার্থপরতা জন্ম দেয়, নিজের প্রতি অবিশ্বাস। কাজেই, এইসব থেকে মুক্ত না হতে পারলে অশান্তি কখনো ছেড়ে যায় না।
সংসারী মানুষের কাছে ত্যাগ একটা বড় বিষয়। তারা ভাবেন, ‘আমরা যদি ত্যাগ করি, খাব কী?’ বুঝতেই পারছেন, সংসারী মানুষের প্রথম চিন্তাই আসে বিষয় নিয়ে।
স্বামী মারা গেলে, অনেককে বিলাপ করতে শুনেছি- ‘তুমি চলে গেলে, আমাদের জন্য কী রেখে গেলে গো!’
এখানেও সেই অর্থ। স্বামী মারা যাবার পর, অনেকেই আগে দেখে নেন, কোথায় কী রেখে গেছেন। আমি বলছি না, সংসারী মানুষের এসব কথা ভাবা ভুল। সবেরই প্রয়োজন আছে। বললাম, মানুষের কাছে মানুষ সাহায্য চাইলে, প্রথমেই তারা ভেবে নেন, হয়তো অর্থ সাহায্য চাইছে। - এই অর্থ-কেন্দ্রিক মনটার কথা আমি বলতে চেয়েছি।
সংসারী মানুষই হোক, কিংবা সাধু – সবাইকেই ত্যাগ করতে হয়। নিঃস্বার্থ ত্যাগ জন্ম দেয় বৈরাগ্যের। লোভ, কামনা, পরশ্রীকাতরতা আর ক্রোধ – প্রাথমিকভাবে এই ৪ টি খারাপ বিষয়কে ত্যাগ করতে পারলে, মানুষ ভগবানের পথে পৌঁছে যেতে পারবেন।