বাবাজী মহারাজের এই কথা ও তার নেপথ্যের ঘটনা ও ব্যাখ্যা বলার আগে আর একটা কথা বলি।
ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন স্যার আলফ্রেড বানার্ড নোবেল। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, তিনিই সেই, যার নামে আজও দেওয়া হয় নোবেল পুরষ্কার, এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরষ্কার।
তার আবিষ্কৃত ডিনামাইট দিয়ে যেমন সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব, তেমনই বিনাশও সম্ভব। কিন্তু, এর জন্য কি ডিনামাইট দায়ী, নাকি যিনি এই ডিনামাইটকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন, তার শয়তানী মানসিকতা দায়ী?
উত্তরটা কী হবে সবাই জানেন।
তাই বাবাজী বলতেন – ‘দেখ বাবা বিষয়ের কোন দোষ নেই, দোষ বিষয়ীর। ব্যবহারকারীর ব্যবহার করার উপর তার দোষগুণ নির্ভর করে।‘
তখন নতুনগ্রামে সবেমাত্র বাবাজী মহারাজ এসেছেন। গ্রামে সেই বার্তা রটে গেছে। নিয়ম করে গ্রামের মানুষজন আসছেন এই তরুণ সন্ন্যাসীর জ্ঞানগর্ভ বাণী ও ভাগবতের ব্যাখ্যা শোনার জন্য।
এর আগে অগ্রদ্বীপের এই নতু্নগ্রাম অনেক সাধু দেখেছে, কিন্তু এ রকম উজ্জ্বলকান্তি, জ্ঞানের হিমালয় স্বরূপ সাধু দেখে নি। যাইহোক, সেদিন বাবাজী মহারাজ যথারীতি শ্রীভাগবতের গুরুকরণের কথা ব্যাখ্যা করছিলেন। কাছে বসে মন দিয়ে তার কথা শুনছিলেন শান্তি ভট্টাচার্য, বিশ্বনাথ, সুনীল বৈরাগীরা।
বাবাজী মহারাজ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বললেন – ‘যতক্ষণ বিষয়ের সঙ্গে যোগ, ততক্ষণ তোমার মুক্তি নেই।‘
শান্তিবাবু বলে উঠলেন, ‘ওসব কথা ওই অবধূতদেরই সাজে। আমরা সংসারী মানুষ। বিষয় ত্যাগ করলে খাব কী? অবধূতরা তো বিয়ে করেন নি, সংসারও নেই। ভাবনা চিন্তা নেই। খায়দায় কাঁসি বাজায়।‘
বাবাজী হাসিমুখে শান্তিবাবুর কথা শুনছিলেন।
শান্তিবাবু এবার ওই তরুণ সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সাধুজী, আমাদের মতো সংসারী মানুষদেরও কি বিষয় ত্যাগের কথা বলেছে ভাগবত?’
বাবাজী মহারাজ বলতে শুরু করলেন - ‘দেখ বাবা বিষয়ের কোন দোষ নেই, দোষ বিষয়ীর। ব্যবহারকারীর ব্যবহার করার উপর তার দোষগুণ নির্ভর করে।“
শিশির কুমার ঘোষাল তার গ্রন্থে লিখেছেন সেদিনের এই ঘটনা।
বাবাজী বললেন –‘যে কম্বলটার উপর তোমরা এখন বসে আছো, সেই কম্বলের কোন বিকার নেই। সে তোমাদের সকলকেই স্থান দিয়েছে। এখন সুনীল যদি সকলকে উঠিয়ে দিয়ে কম্বলটা নিজের বলে বাড়ি নিয়ে চলে যায়, তখন তোমাদের যে কষ্ট হবে, সেটা কম্বলটার জন্য, নাকি সুনীলের ব্যবহারের জন্য?’
সবাই নিশ্চুপ
। সুনীলবাবুও কিছুটা হতভম্ব। ‘ ব্যাপারটা কী হল’ – যেন এরকম একটা ভাব তার চোখে-মুখে।
বাবাজী বলতে লাগলেন – ‘কম্বলরূপ বিষয়টার তো দোষ নেই। তাই বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বিষয় ভোগ করলে ভাল।‘
বাবাজী তখন গীতার একটি শ্লোক পাঠ করে বললেন, ‘ইন্দ্রিয়গুলিই বিষয় অর্থাৎ চলা, বলা স্বাদগ্রহণ, শ্রবণ- এ সবই মনের ক্রিয়া। থেমে নেই। মন এগুলো ভোগ করেই চলেছে। মনে রাখতে হবে, এই ভোগ থেকে মনকে আলাদা করাই সঠিক আচরণ। মনে রাখতে হবে, এই সংসার তাঁর, আমি এই সংসারে আছি মাত্র। ভৃত্য সেজে কাজ করে যাও। কোন ভয় নেই। মালিক সাজতে গেলেই বিপত্তি।‘
বাবাজী মহারাজের জীবনই হলো তার বাণী। সারাটা জীবন তিনি কষ্টের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে। তার চলার প্রতিটি পদক্ষেপে ছড়িয়ে আছে, জীবন পথের সঠিক ঠিকানা। এই বাস্তব জগতের কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করতো না, আবার এই বাস্তবের মাটিকেও তিনি দূরে রাখতেন না। কীভাবে, ‘জগত সত্য, আবার ঈশ্বরও সত্য’ – এই তত্বকে মেনে চলতে হয়, তিনি তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
সারাটা জীবন কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগের সাধনা করে গেছেন তিনি। কষ্টের পাহাড় ভেঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন আমাদের কাছে, আমাদের সঠিক পথের ঠিকানা দেবেন বলে। আমরা তাকে চিনতে পারিনি। এখন অসহায়ের মতো হাহাকার করি, তাকে পাওয়ার জন্য। আর যেদিন তিনি ছিলেন সশরীরে, সেদিন বুঝতে পারিনি তিনি কোন লোকের মহাপুরুষ।
বিভেদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। না গুরু, না শিষ্যে, না মানুষে মানুষে। তিনি বিশ্বাস করতেন আর এক নবজাগরণে, যেখানে জেগে উঠবে মানুষের চৈতন্য, বিবেক।
‘সকলের তরে সকলে আমরা’ – এই কথাটা সবাই বলে উঠবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভুলে। সেদিনের অপেক্ষায় ছিলেন এই তরুণ সন্ন্যাসী।
কিন্তু, দূর্ভাগ্য আমাদের। আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি। কেন জানেন, কোথায় যেন তার প্রতি আমাদের ভালোবাসায় খাদ ছিল।
বাবাজীর আর একটি কথা বলে আজকের মতো লেখা শেষ করবো।
বহুকাল আগে নতুনগ্রামে এক সন্ন্যাসী এসেছিলেন। জায়গাটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সন্ন্যাসী। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসেছিলেন কাছারীবাড়ির আমবাগানের একটি আমগাছের নীচে। জমিদার কন্যার নজরে পড়ে বিষয়টা। তিনি যাচ্ছিলেন দিঘীতে স্নান করতে। তার অসুবিধার কথা জানিয়ে তিনি পিতাকে সব জানান।
জমিদার তার কন্যার কথা শুনে কোন কিছু না ভেবেই লোক-লস্কর নিয়ে হাজির হলেন আমবাগানে। সন্ন্যাসীর সামনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে খারাপ অশ্রাব্য ভাষায় তাকে গালিগা্লাজ করতে লাগলেন।
সন্ন্যাসী শুনলেন।
তারপর রুষ্ট হয়ে ওই জমিদারকে অভিশাপ দিলেন তার বংশ লোপ পাবে। আর ওই গ্রামের হবে দৈন্যদশা।
এলাকার মানুষরা এই কথাটা শুনে এসেছিলেন তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। কিন্তু, তার বহু বহু বছর পর, যখন আর এক তরুণ সন্ন্যাসীর চরণ এসে থামলো সেই আমবাগানেই, সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করল, এবার কেটে যাবে সেই অভিশাপ। নতুনগ্রাম আবার ফুলে-ফলে ছেয়ে যাবে। মানুষের সংসার ভরে উঠবে আনন্দে। তাইই হয়েছিল।
বাবাজী আসার পর তাই হয়েছিল। এখন বাবাজী চলে গেছেন। আবার আকাশটা কেমন কালো হয়ে আসছে।