কী সেই সত্য? আসলে, এই সত্যের জন্যই, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই মহাপুরুষেরা ধরাধামে আসেন। মানুষের অন্তরের সমৃদ্ধি ঘটিয়ে তার চেতনার বিকাশ ঘটাতে চান।
ধর্মের জন্য তাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ১৯৮২ সালের পরও শ্রীজানকীদাসজী কুম্ভে গেছেন। নিজের জন্য পৃথক জায়গা রেখেই সাধু-গুরু-বৈষ্ণব সেবা করে গেছেন।
শ্রীজানকীদাসজীর অন্তরের ইচ্ছা ছিল, শেষ জীবনে বৃন্দাবন ধামে থাকার। মহন্তরা তাকে দেখতে এসে বলতেন – “ব্রজ ছোড়কে আউর মত যাইয়ে জী।“
বাবাজী মহারাজের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর বৃন্দাবনের রমনরেতিতে অল্প একটু জায়গা কিনে আশ্রম তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। প্রথমে একটা ঝুপড়ি মতো ঘর তৈরি হয়। এখানেই তিনি সাধুদের নিয়ে থাকতেন। পরে আরো কয়েকটি পাকা ঘর নির্মান করা হয়। ১৯৮৯ সালের এলাহাবাদ কুম্ভের পর শ্রীদাদাজী মহারাজের শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে।
সেবার প্রয়াগে ছিল প্রবল ঠান্ডা। দক্ষিণ ঝুঁসিতে তার তাঁবু পড়েছিল। শ্রীদাদাজী মহারাজ সেই প্রবল ঠান্ডাতে বালির উপর কম্বল বিছিয়ে রাত কাটাতেন। পরে তার জন্য খাটের ব্যবস্থা হয়েছিল।
কিন্তু, আজন্ম এই সন্ন্যাসী, সেই প্রবল শীতেও নিজের গায়ের শোয়েটার খুলে অন্যকে দিয়ে দিতেন। আসলে, ত্যাগই ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র। তাই সমগ্র জীবনটাই দিয়ে গেছেন তার গুরুদেবের পায়ে আর মানুষের সেবায়।
শ্রীদাদাজী মহারাজ ছোটবেলায় অনেকের কাছেই শুনেছিলেন শৈবতীর্থ তারকেশ্বরের মাহাত্ম্য। বাবা তারকনাথের মন্দিরে ধরণা দিলে না কি বাবা তাকে দেখা দেন, তার মনোস্কামনা পূরণ করেন। তিনি ছুটে এসেছিলেন তারকেশ্বরে। দিনের বেলায় মন্দিরে পুজো দিয়ে, মন্দিরের সামনে ধরণা দেওয়ার ঘেরা জায়গায় ধরণা দিয়েছিলেন।
শ্রীদাদাজী মহারাজ তার সেই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন এইভাবে – রাত ১২ টা বেজে গেছে। অনেকেই তখন ধরণায়। কেউ কেউ অষ্ফুট গলায় কাতর প্রার্থনা করছেন। আচমকা আমি শুনলাম, মন্দিরের ভিতর থেকে কে যেন পরিষ্কারভাবে কিছু যেন বললেন। সেই অদ্ভুত ঘটনায় আমার জীবন ধন্য হয়ে গেল।
যাইহোক, ফিরে আসি মূল ঘটনায়। শ্রীজানকীদাসজী বড়রে এসেছিলেন ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৭ সালে তিনি ব্রজবিদেহী চতুঃসম্প্রদায়ের মহন্ত হিসাবে বড়র আশ্রম থেকে এলাহাবাদ পূর্ণ কুম্ভে গিয়েছিলেন।
পরম্পরা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্রী জানকীদাসজী বলেছিলেন - … যদি আশ্রমটাকে পরম্পরা বলা হয়, তাহলে কাঠিয়াবাবার পুরানো আশ্রম, সন্তদাসজীর আশ্রম আর ধনঞ্জয়দাসজীর আশ্রম, কোনটা পরম্পরা? আগে আশ্রমও ছিল না, পদবীও ছিল না, তাহলে পরম্পরাটা ছিল কোথায়?”
শ্রী জানকীদাসজী বুঝেছিলেন গুরুগিরির পদগুলি মোক্ষলাভের পথে যাচ্ছে, না মান-যশ প্রতিষ্ঠার দিকে যাচ্ছে, সেই ব্যাপারটাই আগে বিবেচনা করা দরকার। পদবী, প্রতিষ্ঠান, কুম্ভমেলা – এই বাইরের জাঁকজমকের দিকে না তাকিয়ে, অন্তর্মুখী গুরুশক্তি ধারার দিকে লক্ষ্য রেখে গুরু নির্দেশিত পথে চলাটাই শ্রেয়।
তিনি এক প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছেন – ‘বাড়ি ও জমি বিক্রির যেমন দালাল থাকে, সাধুদের মধ্যে এইরকম মহন্তাই পদবী বেচা-কেনার দালালও দেখতে পাই। তাই অবাক হয়ে ভাবি – এসবের মধ্যে ভগবান প্রাপ্তির পথ কোথায়? (শ্রী ১০৮ স্বামী জানকীদাস কাঠিয়া বাবাজীর জীবন চরিত, পৃষ্ঠা ২৪৪)
এবার ফিরে যাই আবার বৃন্দাবন ধামে। সালটা ২০১২। কথা চলছে ২৬ নভেম্বর শ্রীসন্তদাসজীর তিরোভাব তিথিতে শ্রীবাবাজী মহারাজ অর্থাৎ শ্রী প্রজ্ঞাদাসজীকে নিম্বার্ক আশ্রমের মহন্ত পদে অভিষিক্ত করা হবে।
বাবাজী মহারাজের সাধু শিষ্য স্বামী সদগুরু দাসজীর ‘শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াবাবা মহারাজের জীবন চরিত’, গ্রন্থে দেওয়া তথ্য থেকে জানতে পারি – ‘বাবাজী মহারাজ তখন আসামে। আসাম ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখে তিনি এলেন বৃন্দাবনে। মহন্তাই পদ গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি শুরু হল।‘
কিন্তু, যে বাবাজী মহারাজ পদ-পদবীকে কোন গুরুত্ব দিতেন না, তিনি এই মহন্তাই পদ গ্রহণের জন্য আসাম ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখে বৃন্দাবন এলেন কেন? আমি এই প্রশ্নের উত্তর এই মুহুর্তে জানি না।
এ ব্যাপারে কারো কাছে যদি অতিরিক্ত কোন তথ্য থাকা, আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন।
তবে, স্বামী সদগুরুদাসজী লিখছেন – ‘মহত্বপূর্ণপ্রাচীন স্থলের মহন্তাই পদ লইবার আহ্বানকে তিনি পরম্পরার আহ্বান হিসাবেই লইয়াছিলেন (মূল গ্রন্থে, পৃষ্ঠা ৭৮, ‘নিয়েছিলেন’ ছিল, এটি চলিত, তাই সাধুতে রূপান্তরিত করা হল)।
(এই অংশটি স্বামী সদগুরুদাসজীর গ্রন্থ থেকে গৃহিত তথ্যের উপর নিজের কথায় লিখলাম।) শ্রীরামদাসজী মহারাজের রেলওয়ে লাইনের ধারে ছোট আশ্রমটিতে স্বামী দীনবন্ধুদাসজী নামে এক সাধু থাকতেন। তিনি মাঝে মাঝে কালীদহ আশ্রমে যেতেন। একবার তিনি কালীদহ আশ্রমে গিয়ে বাবাজী মহারাজকে তার ওখানে দ্বিপ্রাহরিক প্রসাদ পাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। বাবাজী মহারাজও আনন্দের সঙ্গে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন।
তিনি ওই স্থানে গিয়ে ছাদে বসে ভক্তদের বলতে লাগলেন – ‘এই স্থান আমার গুরু দ্বারা। এখানে ঝাড়ু দেবার সূযোগ যদি পেতাম, ধন্য হতাম।
সদগুরুদাসজী লিখছেন –মহন্তাই এর আহ্বানকে তিনি পরম্পরার আহ্বান বলতেন। তখন ওই স্থান নিয়ে কোর্ট কেস চলছিল।
স্বামী সদগুরুর কথায় – কেহ বাবাজীকে বললেন, ওখানে মহন্তাই নিতে গেলে গুলি চলতে পারে।
বুঝুন পাঠকেরা! কী কথা! এই জন্যই শ্রীজানকীদাসজী বলেছিলেন পদ আর পদবী ধর্মের পথ কী সত্যিই দেখায়?
গুলি চলতে পারে। বেশ, ভালো কথা। মন্ত্রীত্বের জন্য, বিধায়ক বা সাংসদ হবার জন্য, কিংবা মাফিয়া কিং হবার জন্য গুলিগোলা চলে। কিন্তু, মঠের মহন্ত হওয়ার জন্য গুলি! পাপের ষোলকলা কি পূর্ণ?
স্বামী সদগুরুদাসজীর লেখায় – ‘বাবাজী মহারাজ অকুতোভয়ে তাকে বললেন “পরম্পরার জন্য যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে গুলিও খাব।“
এরপর ২৬ নভেম্বর কমিটির সদস্যদের উপস্থিতে, শ্রী মহন্ত মহারাজ, চতুঃসম্প্রদায় বিরক্ত বৈষ্ণব পরিষদের এবং নির্বানী আখড়ার সাধুগণ, শ্রীমহন্তগণ এসে চাদর উড়িয়ে বাবাজী মহারাজকে ওই স্থানের মহন্তপদে অভিষিক্ত করলেন।
এখানে উল্লিখিত তথ্য স্বামী সদগুরু দাসজীর ‘শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াবাবা মহারাজের জীবন চরিত’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া। যদি এই ব্যাপারে কারো কাছে কোন অতিরিক্ত তথ্য থাকে, অনুগ্রহ করে লিখে জানাতে পারেন।