পৃথিবীর মাটিতে কেন আসেন ড. শ্রীশ্রী প্রজ্ঞাদাসজীর মতো মহামানবেরা?

মহাপুরুষরা কেন বার বার নেমে এসেছেন এই বাংলা তথা ভারতের মাটিতে? কেন তারা বার বার মানুষের জন্য কাজ করে অকালে বা অসময়ে ফিরে গেছেন তাদের ‘নিজেদের গৃহে’? 

তারক ঘোষ

ই বাংলার মাটিতে একটা সময় ছিল, যখন মহামানবদের আসাযাওয়া চলতো। সমাজ, ধর্ম, মানুষের অন্তরকে পরিষ্কার করার ব্রত নিয়ে নিজেদের সারাটা জীবন তারা উৎসর্গ করে যেতেন মানব-সেবায়। ধর্মের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গ্লানি দূর করার জন্য, সমাজের বুকে নানা অনিয়মকে বদলানোর জন্য, তারা বার বার এনেছেন নব-জাগরণ।
 শ্রীচৈতন্যদেব, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় কী না করে গেছেন এই জাতিটাকে মাথা তুলে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
কুসংষ্কার দূর করার জন্য তারা প্রচলিত ধর্মের বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে গেছেন। কেউ বুঝেছেন, কেউ বোঝেন নি, কেউ, এটাকে ‘ধর্মের অপমান’ মনে করে সেই মাহামনবদের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন। 
দীর্ঘ সময়ের মৌরসী পাট্টা নিয়ে বসে থাকা কুসংষ্কার দূর করার জন্য রবীন্দ্রনাথও তার ‘কর্তার ভূত’ কিংবা ‘অচলায়তন’ লিখেছেন। লিখেছেন ‘রাজা’। ‘রাজা’ প্রবন্ধের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাবাজী মহারাজ বলেছেন – ‘রাজা নাটকে ভক্তির নাম নিয়ে উদ্দামতা নেই। ভক্তির মধ্যে যে সংহত রূপ, তা এখানে পাই।‘ 
বাবাজী মহারাজের কথায় কবিগুরু সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক পথিককে একই জায়গায় দাঁড় করাতে পেরেছেন। এই মহামানবেরা আসেন মানুষকে সঠিক রাস্তা বাতলে দেবার জন্য। কোনটা পথ, আর কোনটা বিপথ, তা চিনিয়ে দেবার জন্য। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের চোখ খুব কম খোলে, আর চোখ খোলা থাকলেও জ্ঞানচক্ষু বুজেই থাকে। 
ফলে, শেষপর্যন্ত সবটাই শ্মশান বৈরাগ্যে পরিণত হয়। আমাদের জগতে এইরকম ভাবেই এসেছিলেন শ্রীশ্রীজানকীদাসজী ও শ্রীশ্রী প্রজ্ঞাদাসজী মহারাজেরা। কিন্তু কেন এসেছিলেন? না, এই প্রশ্ন কতজন করেছেন আমি জানি না। তবে, বাবাজী মহারাজ নিজেই বলেছেন কেন তিনি এসেছিলেন।
আপনারা সকলেই জানেন, বাবা যখন এই পার্থিব দেহে ছিলেন, তখন আশ্রম হয়ে যেত স্বর্গের নন্দনকানন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসতেন ভক্ত ও সাধুজনেরা। কখনো নাটক, কখনো ভাগবত সপ্তাহ, কখনো গীতাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো। আর বাবা আশ্রমে থাকলে প্রতিটি সকাল আর সন্ধ্যা হয়ে যেত সেই প্রাচীন আশ্রমের সুধাধারায় সিক্ত। 
 আমরা সবাই আশ্রমে যেতাম নিজেদের কোন না কোন উদ্দেশ্য নিয়ে। যে কোন ভাবে বাবার কাছ থেকে সুরাহা খুঁজতাম। পারিবারিক সমস্যা থেকে কীভাবে অর্থ আসবে সবই টেনে আনতাম ওই সাধকের সামনে। আমি সবাইকে বলছি না, খুব কম জনই আমরা বাবার কাছে যেতাম পরমার্থের খোঁজে। বাবার পাঠ শুনতাম, ভালোলাগায় আর ধর্মে নিজেদের পূণ্যবান মনে করতাম। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করতাম – ‘আর নয়।‘ এবার জীবনে পরিবর্তন আনতে হবে, যে করেই হোক। 
সেই প্রতিজ্ঞা আমাদের কাছে নিছকই প্রতিজ্ঞা ছিল। বাস্তব ছিল না। আসলে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে যা সামনে নেই, তাকে পাওয়া যে কতো কঠিন, তা একমাত্র মহামানবেরাই জানেন। 
আমাদের মতো জীবনমুখী-সংসারমুখী মানুষের কাছে তা লাভ করা খুবই কঠিন। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবার কাছে কী চাইতে হয়, সেটাই আমরা শিখি নি। ফলে আবদ্ধ থেকেছি একটা চেনা গণ্ডীর মধ্যেই, বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করিনি।
বাবার আক্ষেপ ছিল, এটা নিয়েই। তিনি যে জন্য এসেছিলেন, সেটা কাউকেই বোঝাতে পারেন নি। অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে ছিল, যা থেকে আমরা চেষ্টা করলে হয়তো বুঝতে পারতাম। কিন্তু, চোখ থেকেও, সেই চোখ কোন কাজেই আসে নি। 
যে চোখ শুধু নিজের স্বার্থ দেখে, আত্মীস্বজনের স্বার্থ দেখে, সেই চোখ অন্যদের দেখেও দেখে না। যেমন রাজনৈতিক নেতারা মানুষ বলতে ব্যক্তি মানুষ বোঝেন না, বোঝেন একটা বিশাল ভিড় – জনতা। আর এই জনতাই তাদের কাছে জনার্দন। আর আমাদের কাছে, অর্থই আমাদের জনার্দন।
 আর বাবার কাছে কোনটা ছিল প্রাথমিক কর্ম? আমি জানি – তার শিষ্য আর সাধারণ মানুষ। তাদের মধ্যেই তিনি খুঁজেছেন স্বয়ং ঈশ্বরকে। তিনি তার প্রতিটি শিষ্যের নাম জানতেন, মনে রাখতেন। তাদের ভালো-মন্দের খবর নিতেন। চিঠি দিলে তার উত্তর দিতেন। ফোন করলে ফোন ধরতেন, যদি না গুরুতর কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
তিনি ছিলেন আধুনিক। একবার রাধামাধবদাসজী এসে বাবাজীকে বললেন, আশ্রমের অনুষ্ঠান নিয়ে ভক্তদের চিঠি পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু সময়ে সেই চিঠি না পৌঁছানোয়, ভক্তরা অনেকসময় জানতেই পারছে না। বাবাজী মহারাজ ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক এক সাধক। তিনি রাধামাধবদাসজীকে বলেন, মোবাইল ফোন থেকে মেসেজ পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। বাবাজী ছিলেন দূরদর্শী। তাই কিনেছিলেন একটা ক্যামেরা আর স্ট্যান্ড। 
বলেছিলেন, প্রতিদিনের প্রবচন ও আশ্রমের নানা অনুষ্ঠান রেকর্ড করে রাখতে। যাতে ভবিষ্যতের মানুষ এই আশ্রম সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারেন। কিন্তু, কী হল সেই ক্যামেরার আমরা জানি না। বাবাজী বিজ্ঞানকে ধর্ম থেকে দূরে রাখতেন না বলেই, একটা ওয়েবসাইট চালু করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন একজনকে। কিন্তু, কী হলো সেই ওয়েবসাইটের? 
বাবার স্বপ্ন ছিল ওই ওয়েবসাইটে লেখা থাকবে সাধকদের কথা, নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সব ধর্মের সাধকদের জীবন ও বাণী, যাতে সেই সব কথা ছড়িয়ে পরতে পারে, এই বিশ্বের প্রতিটি কোণে। কিন্তু, সেসব আজ ঢাকা পরে গেছে সময়ের ধুলোয়, যেমন ঢাকা পড়ে গেছে বাবার নানা স্বপ্ন – আশ্রম, গ্রাম আর মানুষকে নিয়ে। সেই সব অজানা কথাই আপনাদের শোনাবো আমার পরবর্তী গ্রন্থ – ‘কেন এসেছিলাম’ তে।
বাবা সাংবাদিকদের কাছেই মন খুলে কথা বলতেন। সেখানে তার নানা উদ্দেশ্যের কথা বলে গেছেন। বাবার সঙ্গে তপোবন আশ্রমে আমার দীর্ঘক্ষণব্যাপী আলোচনা হয়েছিল বহু বছর আগে। আমি তখন একটা নামী নিউজ চ্যানেলের নিউজ এডিটর। অনেক কথাই বলেছিলেন।
 অনেক কিছু লেখার কথাও বলেছিলেন। কিছুই করতে পারি নি। বুঝি, সময় না হলে, কিছু হয় না। তখন হয়তো সেই সময় আসেনি। আজ বদলে যাওয়া সবকিছুর মাঝে তার অভাবটাই বড়ো মনে হচ্ছে। তিনি দেহরূপ সত্বায় আজ নেই ঠিক, কিন্তু আছেন আমাদের মনে আর চেতনায়। তারই ইচ্ছায় লিখে চলেছি। হয়তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ----।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad