পুরাণ, কাব্য, পদাবলীর পথে পথে শ্রীরাধা কখনো বাস্তব, কখনো পরকীয়া, কখনো বা নিছক কল্পনা



শ্রীরাধা কি শ্রীকৃষ্ণের মামী? তিনি কি সত্যিই বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রেম-লীলায় মেতে উঠেছিলেন ? শ্রীরাধা কি রায়ান (আইহোন, আয়ান) এর স্ত্রী? শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সত্যিই কি তার বিবাহ হয়েছিল? বৃন্দাবন ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পর তার সঙ্গে শ্রীরাধার আর দেখা হয়েছিল কিনা, রুক্মীনি কে? কোন কোন পুরাণে কীভাবে শ্রীরাধার বর্ণনা এসেছে, ভাগবতে তার উল্লেখ নেই কেন, কীভাবে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের পাশে শ্রীরাধার স্থান হলো, শ্রীরাধার শেষ পরিণতি কী হয়েছিল – 
এরকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর উপযুক্ত তথ্যের সাহায্যে আমি তুলে ধরার চেষ্টা করব এই ধারাবাহিক রচনায়। আর শ্রীরাধা কীভাবে উঠে এসেছেন নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মধ্যে, সেটির ব্যাপারেও আলোকপাত করা হবে এই নিবন্ধগুলিতে।
শ্রাবনের রাত। নিকশ কালো রাত। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের তীব্র ঝলক বিদীর্ণ করছে রাতের আকাশে। আর ক্ষণপ্রভার সেই ক্ষণিক আলোকছটায় আলোকিত হয়ে উঠছে এক যৌবনবতীর আসামান্য রূপ-যৌবন। মাঝে মাঝে পিছল রাস্তায় পা পিছলে যায়। তবু তাকে যেতেই হবে। 
তাকে যে ডাকছে তার প্রাণসখা। তার বাঁশির সুর মেঘের গুরু গুরু ধ্বনিকেও হার মানিয়ে প্রবেশ করছে তার কর্ণকুহরে। আবার পা পিছলে যায় কর্দমাক্ত পথে। অথচ এর জন্য তিনি কত অভ্যাসই না করেছেন— “গাগরী বারি ঢালি করি পিছল, চলতহি অঙ্গুলি চাপি-“ 
চিনতে পারছেন এই নারীকে? কাব্যের আঙ্গিনায় তার নাম রাধা।
আজ থেকে শুরু হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক আছে ভারতের পণ্ডিত সমাজে, এমনকি বৈষ্ণব সমাজেও। আবার পাশাপাশি আছে এক চরম বিশ্বাস, যে বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে শ্রীরাধা আমাদের শুধু মাধবের হৃদয়ে নয়, আপামর হিন্দুদের মনের মন্দিরে স্থান পেয়েছে্ন।
 আবার এরকম মত উঠে এসেছে এই বাংলা থেকেই বড়ু চণ্ডীদাস তার শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণকে অঙ্কন করেছেন এক গ্রাম্য নারীদেহলোলুপ যুবক হিসাবে। একইসঙ্গে রাধাকে দেখানো হয়েছে – রাধা যেন এক নিতান্তই স্বামী-সংসারে আবদ্ধা কূলবধূ, যিনি কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনী হয়ে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিছুটা পুরাণ, কিছুটা কল্পনা – এইভাবেই তিনি রচনা করেছিলেন রাধা-কৃষ্ণ চরিত্র। 
তাদের শরীর থেকে দেবত্বের তকমা সরিয়ে পরিণত করেছিলেন রক্ত-মাংসে গড়া এই সংসারের আর পাঁচটা নারী-পুরুষের মতো করে। 
আবার, জয়দেবের গীতগোবিন্দ রাধা-কৃষ্ণের কাহিনীকে এক অনাস্বাদিত প্রেম-কাহিনী রূপে ছড়িয়ে দেন সারা দেশ জুড়ে। পায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। আর এই জনপ্রিয়তার মূলে বিশেষ অবদান ছিল শ্রীচৈতন্যের। ফলে ভারতের সব রাজ্যেরই নৃত্য–গীত–নাট্য–কাব্য–চিত্রকলায় গীতগোবিন্দ তথা রাধাতত্ত্ব স্থান পেয়েছে ষোড়শ শতক থেকে।
তবে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে এই পরকীয়া রাধার ক্রমবিকাশ এবং প্রতিষ্ঠার জোরালো ভূমি হলো এই বাংলা। শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধার প্রেম বিষয়ক বহু গাথা, কবিতা বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। 
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা সুবিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। বাংলার ভক্তি আন্দোলনেও এর সুদুরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল। এমনকি মিথিলার কবি বিদ্যাপতিও শ্রীরাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে বহু পদ রচনা করেছিলেন। 
তবে, বড়ু চণ্ডীদাস প্রথম থেকেই কৃষ্ণ চরিত্রকে নারীলোভী কামুক পুরুষ হিসাবেই দেখিয়েছেন। রাধাকে দৈহিকভাবে পাওয়ার জন্য তিনি নানা ছলনা, প্রতারণা, নীচতা ও অভিনয়ের আশ্রয় নিয়েছেন। তারপর তার সঙ্গে বারবার মিলিত হয়ে তার তৃষ্ণার উপশম ঘটে ও শেষপর্যন্ত শ্রীরাধাকে ফেলে তিনি নির্দ্ধিধায় চলে যান মথুরায়। যদিও, এসবই পদকারের কল্পনার ফসল। 
যেখানে প্রয়োজন, সেখানে তিনি টেনে এনেছিলেন পুরাণের প্রসংগ,  আর যেখানে প্রয়োজন মনে করেছেন, সেখানে তার স্বাধীন কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। এই লেখায় আমি দেখানোর চেষ্টা করব, শ্রীরাধা কে। তার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের কী সম্পর্ক। শ্রীরাধাকে আমরা প্রথম কোথায় খুঁজে পাই।
তাকে নিয়ে যে হাজার প্রশ্ন – তিনি শ্রীকৃষ্ণের মামী কিনা, তিনি কি সত্যি বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রেম-লীলায় মেতে উঠেছিলেন ? শ্রীরাধা কি রায়ান (আইহোন, আয়ান) এর স্ত্রী? শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সত্যি তার বিবাহ হয়েছিল? বৃন্দাবন ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পর তার সঙ্গে শ্রীরাধার আর দেখা হয়েছিল কিনা, রুক্মীনি কে । 
কোন কোন পুরাণে কীভাবে শ্রীরাধার বর্ণনা এসেছে, ভাগবতে তার উল্লেখ নেই কেন, কীভাবে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের পাশে শ্রীরাধার স্থান হলো, শ্রীরাধার শেষ পরিণতি কী হয়েছিল – এরকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর উপযুক্ত তথ্যের সাহায্যে আমি তুলে ধরার চেষ্টা করব। 
 আসুন, কীভাবে বড়ু চণ্ডীদাসের রচনায় কৃষ্ণ চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তার একটা নমুনা আমরা দেখি । “রাধে, তোমার এই নব যৌবনের সুষমা অহরহ আমার মনে জাগিতেছে। তাহাতে আবার তোমার সহিত রমণেচ্ছা প্রবল হইয়া আমার হৃদয়কে অতিমাত্রায় কর্ষণ করিতেছে।”
 শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন (চণ্ডীদাস বিরচিত): বৃন্দাবন খণ্ড পৃষ্ঠা-৮৯ 

আবার তার লেখনীতে রাধা হয়ে যান কৃষ্ণের মামী। 
 “সম্বন্ধ না মানে কাহ্নাঞিঁ মোকে বোলেঁ শালী। 
লজ্জা দৃষ্টি হরিল ভাগিনা বনমালী 
 দেহ বৈরি হৈল মোকে এরুপ যৌবন।
 কাহ্ন লজ্জা হরিল দেখিআঁ মোর তন - 
 শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনের দানখণ্ড : রামগিরীরাগ : পৃষ্ঠা : ২০
 (শব্দার্থঃ মাউলানী- মামী, কাহ্নের- কৃষ্ণের) 
দেখেছেন এই শ্রীরাধা কে শ্রীকৃষ্ণের মামী বানিয়েছেন বড়ু চণ্ডীদাস।
শ্রীকৃষ্ণের জীবনী তে শ্রীরাধা নামে কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। মামীর সম্পর্ক তো দূরে থাক, রাধা নামে কোনো গোপী শ্রীকৃষ্ণের সমগ্র জীবনীতে ছিলই না। 
এই রাধার উৎপত্তি এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মামির সম্পর্ক তথা অবৈধ্ সম্পর্কের সৃষ্টিকার হলেন কিছু “রসময় সাহিত্যিক চরিত্রের বৈষ্ণব মানুষ ও তাদের তৈরী কিছু কাব্য”। আমরা যদি ভাগবতের দিকে তাকাই, দেখবো সেখানে শ্রীরাধার কোন অস্তিত্ব নেই।
 শুধু, ভাগবতে কেন, বিষ্ণুপুরাণে, হরিবংশে বা মহাভারতে কোথাও শ্রীরাধার নাম নাই। অথচ এখনকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। শ্রীরাধা ছাড়া কৃষ্ণ নাই। শ্রীরাধা ছাড়া কৃষ্ণের মন্দির নাই বা মূর্তি নাই। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলে রাখি - আনুমানিক ৫০০ বছর আগে নিত্যানন্দের স্ত্রী জাহ্নবী দেবী নয়ন ভাস্করকে দিয়ে শ্রীরাধার মূর্তি তৈরি করিয়ে বৃন্দাবনে গিয়ে জীব গোস্বামীর অজ্ঞাতে শ্রীকৃষ্ণের পাশে বসিয়ে রেখে আসেন। তার আগে কৃষ্ণের পাশে রাধার মূর্তি কোনদিনই ছিল না।
দেখা গেছে, বৈষ্ণবদিগের অনেক রচনায় কৃষ্ণ অপেক্ষাও রাধা প্রাধান্যলাভ করেছেন যদিও মহাভারতে, হরিবংশে, বিষ্ণুপুরাণে বা ভাগবতে ‘রাধা’ নেই। 
 উপনিষদ সকলের মধ্যে একখানির নাম গোপালতাপনী। কৃষ্ণের গোপমূর্তির উপাসনা এটার বিষয়। রচনা দেখে মনে হয় যে, অন্যান্য উপনিষদের চেয়ে এটা অনেক আধুনিক ও নবীন। এখানে কৃষ্ণ যে গোপগোপীপরিবৃত সেটা বলা হয়েছে। 
কিন্তু এখানে গোপগোপীর যে অর্থ করা হয়েছে, তা প্রচলিত অর্থ থেকে ভিন্ন। গোপী অর্থে “অবিদ্যা কলা”।
 টীকাকার বলেন,- “গোপায়ন্তীতি গোপ্যঃ পালনশক্তয়ঃ।” আর গোপীজনবল্লভ অর্থে “গোপীনাং পালনশক্তীনাং জনঃ সমূহঃ তদ্বাচ্যা অবিদ্যাঃ কলাশ্চ তাসাং বল্লভঃ স্বামী প্রেরক ঈশ্বরঃ।” 
উপনিষদে এরূপ গোপীর অর্থ আছে। কিন্তু রাসলীলার কোন কথাই এখনে নাই। রাধার নামমাত্র নাই। এক জন প্রধানা গোপীর কথা কাছে, কিন্তু তিনি রাধা নন, তার নাম গান্ধর্বী। 
তবে এ ‘রাধা’ এলেন কোথা থেকে?

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad