আপনারা সকলে জানেন, বাবাজী মহারাজের জীবন ও কর্মে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা কতখানি ছিল! তিনি তার প্রবচনে শিষ্যদের ভাগবত-গীতার পাঠ ও ব্যাখ্যা শোনাতে শোনাতে, বক্তব্যের উপযোগী কবিগুরুর কবিতা বা কবিতাংশ শোনাতেন।
বিশ্বকবি তার জীবন-সায়াহ্ণে পৌছে যে কবিতাগুলি লিখেছিলেন, তার একটি হলো ‘রূপ-নারায়ণের কূলে’।
সেই কবিতায় তিনি বলছেন –
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,’
স্বামী ভূতেশ্বরানন্দজী বলেছিলেন - ভগবানকে ধরে থাকলে, দুঃখ থাকবে না, এরকম নয়; কিন্তু, সেই দুঃখের মধ্যেও আনন্দ থাকবে। তিনি আরো বলেছিলেন – ‘যদি জানতাম দুঃখ অনিবার্য, তাহলে বিচলিত হতাম না।‘ বাবাজী মহারাজ রবীন্দ্রনাথের মতোই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে ভীষণভাবে অন্তরে স্থান দিয়েছিলেন। তার প্রবচনে বারবার উঠে আসতো ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের কথা।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থে ঠাকুর বলছেন – ‘সাধুরা ঈশ্বরের উপর ষোল আনা নির্ভর করবেই। তাদের সঞ্চয় করতে নেই। সংসারীর পক্ষে সংসার প্রতিপালন করতে হয়। তাই সঞ্চয়ের দরকার। পনছি অউর দরবেশ সঞ্চয় করে না।‘
এই কথাগুলি বাবাজীও বহুবার বলেছেন। নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের অনেক গুরুদেবও এই কথা বলেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলছেন – “যারা শুধু পণ্ডিত, কিন্তু ভগবানে বিশ্বাস নেই, তাদের কথা গোলমেলে। সামাধ্যয়ী নামে এক সাধু বলেছিলেন – ঈশ্বর নীরস, তোমরা নিজের প্রেমভক্তি দিয়ে সরস করো।‘’
‘গীতা, গীতা’, দশবার বলতে বলতে ‘ত্যাগী’ হয়ে যায়। গীতায় এই শিক্ষা – ‘হে জীব, সব ত্যাগ করে ভগবানকে লাভ করার চেষ্টা করো। সাধুই হোক, সংসারীই হোক, সব আসক্তি ত্যাগ করতে হয়।‘
আর দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় কী?
দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় হলো দুঃখটাকেই ত্যাগ করা। দুঃখের কারণে ভগবানকে দোষ না দিয়ে, ভগবানকে ত্যাগ না করে দুঃখটাকেই ত্যাগ করা। মনে রাখবেন, যারা অন্যায়ভাবে কারো দুঃখের কারণ হয়, তারা তাদের দেওয়া দুঃখটাই তারা এমনভাবে ফেরত পায়, সারাটা জীবন সেই দুঃখের বাইরে তারা আর বেরোতে পারে না।
কামনা দুঃখের কারণ হয়।মায়া তাকে ঘিরে ধরে। কেউ কামনা আর লোভের বশে তাদের পিতা-মাতাকে দুঃখ দিতেও ছাড়ে না। তাদের প্রতি মুহুর্তে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে।
গীতায় বাবাজী মহারাজ বলছেন – কারো মনে গাড়ি কেনবার কামনা জন্মালো। ঠাকুর দেবতার কাছেও সেই কামনা পূরণের ইচ্ছাও জানালো। একসময়, সে ফল লাভ করলো। পরে, সেই গাড়ির ধাক্কা খেয়ে কারো মৃত্যু হলো, আর মালিকের জেল হলো।‘
বাবাজী বলছেন – ‘ভগবানের কাছে যে যা চায়, সে তাইই পায়। তাই ভগবানের কাছ থেকে কোন কিছু চাইতে হয় সাবধানে। ভক্তকে যে জিনিস বেধে রাখে, তা হলো ক্ষুদ্র ফল-কামনা। ফল-কামনা ত্যাগ করে ভগবানের আরাধনা করটাই শ্রেয়।‘ গীতার ব্যাখ্যায় বাবাজী মহারাজ লিখছেন – ‘দেবদেবীর ক্ষমতা সীমিত। তারা মোক্ষ দান করতে পারেন না।
মুচুকুন্দকে দেবতারা বলেছিলেন – আমরা মোক্ষ দিতে পারি না। দেবতার ভক্তরা দেবতাদের লাভ করেন, কিন্তু তাতে জন্ম-মৃত্যু রোধ করা যায় না। আর যারা ভগবানকে লাভ করেন, তাদের আর দুঃখময় সংসারে ফিরতে হয় না।
শ্রীজানকীদাসজী, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বাবাজী মহারাজ বলেছেন – বিপদ ভিতর থেকেই আসে। কাজেই দুঃখ বাইরে থেকে আসে না। দুঃখের অনুভূতি ভিতর থেকেই আসে। আর এই ‘আসার’ কারণ হলো, দুঃখ আমরা পেতে চাই। কিন্তু, দুঃখকে যদি পেতে না চাই, তাহলে দুঃখ এলেও কষ্ট না দিয়েই ফিরে যাবে।
কথাগুলো একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে।
কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র একবার একজনকে বলেছিলেন, তুমি যদি তীরের সামনে বুক দিয়ে দাঁড়াও, তাহলে তীর তোমাকে বিদ্ধ করবেই।
দুঃখ হলো সেই তীর, যা বাইরে থেকে এলেও, ভিতরে থাকে দুঃখের অনুভূতি। যদি, সেই অনুভূতিটা ত্যাগ করা যায়, তাহলে দুঃখের কারণে ব্যাথা পেতে হবে না। আর ভালো-মন্দ, আনন্দ-বেদনা সব কিছুকেই যদি ঈশ্বরের দান বলে মেনে নেওয়া যায়, তবেই এটা সম্ভব। আর এর জন্য নিজেকে নির্লিপ্ত করতে হবে।
বাবাজী বলতেন, পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। আর পাপ এর বাপ কে? পাপের বাপ হলো লোভ। চোখের সামনে এখন আপনারা লোভের পরিণতি দেখতে পাচ্ছেন।
কিন্তু, বহু মানুষ তাদের অজান্তে এমন কিছু পাপ করে ফেলেন, তারা নিজেরাও সেটা জানতে পারেন না। কিন্তু, ভগবানের হিসাব-নিকাশের খাতায় সব লেখা থাকে।