তারক ঘোষ
আমি জানি
এই লেখা অনেকের পছন্দ হবে না। কিন্তু কী করবো, আমাদের বাবাজী ছিলেন সত্যের পূজারী,
অধর্ম আর অন্যায় এর প্রতিবাদী মুখ। যা কিছু অন্যায়, তা বলার মধ্যে ভয় কোথায়, আর লজ্জাই
বা কী। তাতে কে পড়লো, কে আড়ালে শাসালো, তাতেই বা কী এসে গেল। মানুষ দেখছে, এটাই বড়
কথা। আর ভন্ড সাধুদের তালিকা এর আগেও তৈরি হয়েছে, এখনও সেই ভন্ডদের উপর নজর আছে, যাদের
নজর রাখার কথা।
প্রথমেই বলি, বাবাজী মহারাজ শ্রীশ্রী ডক্টর প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া মহারাজের আদর্শ ও ভাবধারাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই আমার এই বিশেষ নিবন্ধগুলি। প্রতিদিন ভারত সহ বিশ্বের ১১ টি দেশের কমবেশি ১১০০ বাঙা্লি পাঠক এই লেখাটি পড়েন। তাই আপনাদের কয়েকটি কথা বলার প্রয়োজন আছে। সেগুলো হলো – আমাদের বাবাজী মহারাজ চেয়েছিলেন কুসংষ্কারমুক্ত বৈষম্যহীন সুস্থ সমাজ, ধর্মের একটা সুসংহত রূপ।
তিনি চেয়েছিলেন প্রতিটি মানুষের শিক্ষা ও কাজ। তার প্রতিবাদ ছিল অন্যায়
ও অধর্মের বিরুদ্ধে। তিনি মনে করতেন, প্রকৃত সাধু সমাজের একটা দায়িত্ব আছে সুস্থ সমাজ
গঠনে। আর বিশ্বাস করতেন, একশ্রেণির সাধুদের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সৎ গৃহী মানুষের। কারণ
গৃহীরাই পারে এই সমাজকে একটা সুস্থ সমাজে পরিণত করতে। আধ্যাত্মিক চেতনা বিকাশ ও সেটা
পালন করে যাওয়া এক একটা পরিবার হয়ে উঠবে সুস্থ সমাজের সুকঠিন স্তম্ভ।
আমরা গুটিকয়
সাংবাদিক বাবাজী মহারাজের সেই স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য মানুষের কাছে আবেদন রাখছি –
ভালো ও মন্দের তফাত আপনারাই ঠিক করুন। নিঃষ্কাম কর্মের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বৈরাগ্যের
বীজ, প্রতিদিন গুরু প্রদত্ত মন্ত্র জপ করে নিজেদের অন্তরকে পবিত্র করুন, কারণ ঈশ্বরের
বাসভূমি মন্দির নয়, আপনাদের হৃদয় মন্দির।
আমি জানি, সাধু সমাজের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে লোভ, একশ্রেণির সর্বত্যাগী সাধুদের এখন মোটা মোটা ব্যাঙ্ক একাউন্ট, বিলাসী জীবন। একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেরে এই ‘সাধু’রা বিমান ব্যবহার করেন, কিংবা ট্রেনের এসি ফার্স্ট ক্লাস। দেখে মনে হয়, এরা কী ত্যাগ করে এলেন? যারা নিজেরাই ভোগে নিমগ্ন, তারা কীভাবে শিষ্যদের ত্যাগ করার উপদেশ দেবেন?
আসলে, এই শ্রেণির ‘সাধু’দের
কাছে সন্ন্যাস জীবনটাও একটা পেশার রূপ নিচ্ছে। কিন্তু মনে রাখবেন, এই গুটিকয় ‘বিলাসী
অর্থবান সাধু’ কিন্তু এই ভারতের মূল ছবি নয়। এর বাইরে আছে এক সুবিশাল সাধু-সমাজ, যাদের
ঝাঁ চকচকে আশ্রম নেই, যাদের ব্যাঙ্কে একাউন্ট নেই, যাদের নিজস্ব গাড়ি নেই, যাদের ধনী
শিষ্য নেই, কিংবা আশ্রমে ‘বিনিয়োগ করার মতো কালো টাকার পাহাড় গড়া ব্যবসায়ী’ শুভান্যধায়ী
নেই।
এই প্রসঙ্গে
আর একটা কথা বলি, আমি এই কথাগুলো লিখছি, কারণ এটা সত্য। কেন সত্য? কারণ আমাদের বাবাজী
মহারাজ ও দাদাজী মহারাজ এই ধরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।
আপনাদের যদি মনে হয়, এগুলো সত্য নয়, তাহলে হয়, আপনারা নিজেদের সত্য থেকে লুকিয়ে রাখার
চেষ্টা করছেন, নয়তো ভাবছেন, ‘কী হবে এসবে থেকে, যে যা পারে করুক’। সবাই যদি এটা ভাবতে
থাকেন, তাহলে, যে সমাজের স্বপ্ন বাবাজী মহারাজ দেখতেন, তা কোনদিনই আসবে না। সমাজে যা
চলছে, তার একটা প্রতিফলন সাধু সমাজের উপরও পড়ে। যারা সত্যিই সর্বত্যাগী, জ্ঞানী তারা
লোভের ফাঁদে পা দেন না আর যারা অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে, এটাকে পেশা মনে করেছেন, তারা
চেষ্টা করবে কীভাবে বেশভূষা ভাঙ্গিয়ে আরো অর্থ উপার্জন করে ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স বাড়ানো
যায়।
বাবাজী মহারাজ তাই বলতেন, একজন সৎ গৃহী হাজারটা সাধুর চেয়ে অনেক মূল্যবান। ভারতের নানা ধর্মীয় মেলায় বহু সাধু-সন্ন্যাসী দেখেছি। এদের অনেকের আশ্রম নেই, কিন্তু আছে জ্ঞান, এদের চাহিদা নেই, শুধু মানুষের মঙ্গলের জন্য তাদের মনকে ঠিক পথে আনার চেষ্টা চালান। এই জ্ঞানী দরিদ্র সন্ন্যাসীদের দেখে মনে হয়েছে, এরা আছেন বলেই এখনো সাধু সমাজের উপর মানুষের ভক্তি আছে, নইলে এক একজন তথাকথিত অর্থবান সাধুদের জীবন-যাপন দেখে গৃহী আর সন্ন্যাসীর মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কিনা তা বোঝা যেত না।
আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন, এখানে সেই সমস্ত ‘সাধু’দের কথা বলা হচ্ছে, যারা অন্যায়ভাবে কালোটাকা অনুদান নিয়ে নিজেদের ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স বানিয়েছেন, যারা গোপনে এমন কাজ করেন, যা ভারতের সাধু সমাজ ও আইনএর চোখে অপরাধ, তাদের কথা। সকল সাধুদের কথা নয়। মনে রাখবেন, এই ধরণের সাধু থেকে বাবাজী মহারাজ সাবধান থাকতে বলতেন, কারণ, এরা মানুষকে কিছু দিতে পারবেন না, এদের বিলাসী জীবন, ভক্তদের অনুসরন করতে উৎসাহ দেবে না।
মানুষ জানে, সাধু কী। তারা কীভাবে
ভক্তের হৃদয়ে স্থান নেয়। কিন্তু, আশ্রম যদি, ক্রমশ, কর্পোরেট হয়ে ওঠে, তাহলে ভাবার
দিন শুরু। যারা নিজেরা রিপু জয় করতে পারে না, তারা কীভাবে ভক্তদের রিপু জয় করতে শেখাবে?
অবশ্য,
আমাদের সমাজে বহু ভক্ত আছেন, যারা দরিদ্র জ্ঞানী সাধুর চেয়ে ঝা চকচকে বিরাট আশ্রমের
অধিকারী, সাধুদের কাছেই ছুটে যান। গরীব সাধু না-পসন্দ।