বাবাজী মহারাজ বলতেন – “মন্ত্র দিতে তো সময় লাগে না। সময় লাগে সেই মন্ত্র নেওয়ার জন্য নিজেকে
উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে।“
তারক ঘোষ
মনে রাখবেন শাস্ত্রে বলা হয়েছে – “শিষ্য অনেকসময়েই নানা ভুল করে, অন্যায় করে আর তার শাস্তির একটা বড় অংশ গিয়ে পরে গুরুর উপরে। দোষ করে শিষ্য আর ফল ভোগেন গুরু। তাই দীক্ষার পর প্রতিটি শিষ্যের উচিত - কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গুরুর থেকে মত নেওয়া। গুরুর প্রতি কখনোই অসম্মান প্রদর্শন করতে নেই। তাতে ইষ্ট রুষ্ট হয়ে যান। আর গুরু যদি কখনো শিষ্যের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তার মন্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হন তখন শিষ্যের উপর যে ঘোর বিপত্তি নেমে আসে তা সামাল দেওয়ার শক্তি কিন্তু জগতে কারোরই থাকেনা। এমনকি ইষ্ট নিজেও সেই শিষ্যকে বাঁচাতে যান না।
সাধারনত শিষ্য যখন অসুস্থ হয়ে পরে তখন গুরু তার জপ বাড়িয়ে দেন যাতে শিষ্য তার জপের শক্তিতে তাড়়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে। একইভাবে শিষ্যের কর্তব্য - গুরু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের জপের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া উচিত, যাতে গুরু সুস্থ হয়ে ওঠেন। কারণ গুরুর অধিকাংশ ভোগ আসে শিষ্যের খারাপ কর্ম থেকে। তাই শিষ্যের কর্তব্য - সেটি যথাসম্ভব কম গুরুর উপর চাপানো। “
সদগুরুরা এই ধরণীতে আবির্ভূত হন দেওয়ার জন্য, নেওয়ার জন্য নয়। আর তারা যেটুকু নেন, তা শুধুমাত্র গ্রাসাচ্ছদনের জন্য। অতিরিক্ত থাকলে তা ব্যয় করে যান শিষ্য তথা সমগ্র মানব কল্যাণে। তারা যেটা দিতে আসেন – তা হল জ্ঞান- যাতে শিষ্যরা সেই জ্ঞান আহরণ করে সঠিক জীবন পথে চলতে পারে। কিন্তু, অধিকাংশ শিষ্যই সেই জ্ঞান নিতে ব্যর্থ হন, কেননা জ্ঞানকে কাজে লাগানো খুব কঠিন। এর জন্য সংসারী শিষ্যকেও নানা ধরণের সংযমের পরিচয় দিতে হয়।
এই ধরণের শিষ্যরা তাদের গুরুদেবের কথা
মন দিয়ে শোনে, ক্ষেত্রবিশেষে আশ্রমে থাকাকালীন তারা এমন ভাব দেখায় যেন বাড়ি ফিরেই
গুরুবাক্য মেনে নতুন জীবন শুরু করে দেবে। কিন্তু, ওই আশ্রমের গণ্ডীর মধ্যেই তাদের এই
ভাবান্তর। বাড়ি ফেরার কয়েকদিন পরে যাকে তাই। সেই মিথ্যা বলা, ঘুষ নেওয়া, অন্যায় করা,
অন্যায় পথে চলা। সব সেই আগের মতোই। আমি সকলের কথা বলছি না, বলছি তাদের কথা যারা নিজেদের
ভুল জীবনকে শোধরাবার জন্য গুরুদীক্ষা নিতে যান, অথচ কিছুমাত্র পালন করে না, গুরুদেবের কথা।
এই শ্রেণীর শিষ্যরা যতটা লাফালাফি করে দীক্ষা নিয়ে ফেলেন, গুরুবাক্য পালনে
ততটাই ধীরগতি। ‘জয়গুরু’ বলে একটা প্রণাম সেরে নিয়েই ভাবে গুরুদেবকে অনেক ভক্তি করে
ফেললাম। তারা এত বোকা জানেই না, গুরুদেবরা প্রণাম বা ভক্তি চান না, তারা চান, তাদের
বলা উপদেশ মেনে শিষ্যরা চলছে কিনা। সমাজের প্রতি, সংসারের প্রতি তারা ন্যায় করছে কিনা।
এরকম বহু মানুষ আছেন, যারা গুরুদীক্ষা নিয়েও কোনরূপ বদলায় নি, শুধু আশ্রমে তাদের অন্যায়
পথে উপার্জনের টাকা দান করে, ভাবে –সব পাপ ধুয়ে গেল। এদের নিয়ে বাবাজী মহারাজ সেই ‘বাগানে
বেড়া দেওয়ার’ গল্পটা বলেছিলেন। আগে এই প্রসঙ্গে লিখেছি।
আমি জানি, যারা এই ধরণের শিষ্য তারা আমার মুণ্ডপাত করবেন আর যারা নন, তারা
চেষ্টা করবেন, আমি কেন এই কথাগুলো লিখছি, সেটা ভাবতে। এই লেখার উদ্দেশ্য কারোর ব্যক্তিগত
অধিকার নিয়ে সমালোচনা নয়। একজন সদগুরু-শিষ্যকে কেমন ভাবে জীবনে চলতে হয়, সেটার উদাহরণ
হিসাবে। আর এই লেখা আমি লিখছি একজন সামাজিক মানুষ হিসাবে, আর পেশাগত দিক থেকে সমালোচক
সাংবাদিক হিসাবে। আর যা লিখছি, সব ঘটনার আমি প্রত্যক্ষ্যদর্শী।
এই ধরণের শিষ্যরা নিয়মিত গুরু-প্রদত্ত মন্ত্র জপ করার সময়ও বের করতে পারে না, দিন-রাতের ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে। যে শিষ্যরা এই শ্রেণির, তারা আমাকে মনে মনে অভিসম্পাত না করে একটু মিলিয়ে দেখে নিতে পারে। বাবাজী মহারাজ এই শ্রেণীর মানুষদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন দুটি কথা – একটি হল শ্মশান বৈরাগ্য ও অন্যটি হল – ভবী ভুলবার নয়।
অথচ, আশ্রমে গিয়ে এই ধরণের ‘ভক্ত’রা দীক্ষা নেওয়ার জন্য বাবাজীকে যেভাবে
ব্যতিব্যস্ত করে তুলত, না দেখলে বুঝতে পারবেন না। বাবার কাছে তাদের আবদার – আজই দীক্ষা
দিতে হবে। বাবা বলছেন, আগে দেখ, তুই মেনে চলতে পারবে কিনা। নিজের মনটাকে আগে সেইভাবে
তৈরি কর, দিন কয়েক ভাব, সকলের সঙ্গে আলোচনা কর, তারপর যদি দেখিস তোর মন ঈশ্বরের পথে
চলার উপযুক্ত, তখন দীক্ষা দেব। মন্ত্র দিতে তো সময় লাগে না। সময় লাগে সেই মন্ত্র নেওয়ার
জন্য নিজেকে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে।
বাবাজী মহারাজ ‘গুরুপূর্ণিমা’ প্রবন্ধে লিখছেন – যে গুরুদেব আমাকে সমস্ত দুঃখে্র পরপারে নিয়ে যান, সেই গুরুদেবকে অন্ততঃ বছরের একটা দিনও যদি আমরা স্মরণ না করি, তাহলে বোধহয় একটু অকৃতজ্ঞতাই হয়।
শ্রীনিম্বার্কাচার্য্য বলেছেন –
“গুর্ব্বথং যস্য প্রাণাদি যৌবনং ধনমেব চ।
আত্মাত্মীয়েসু নির্ব্বিণ্ণোহধিকারী সম্যগীর্য্যতে।।“
গুরুসেবা কীভাবে করতে হয়, সে প্রসঙ্গে শ্রীনিম্বার্কাচার্য্য বলেছেন –
শ্রীগুরু চরণে নিজের মন, প্রাণ সমর্পন করে তাকে প্রয়োজনে চাকরের মতো, কখনোবা
পুত্রের মতো আবার প্রয়োজনে বন্ধুর মতো হয়ে কিংবা প্রয়োজনে স্ত্রীর মতো হয়ে তার সেবা
করতে হয়।
সবাই একলব্যের মতো শিষ্য হতে পারে না, কিন্তু গুরুবাক্য পালন বা তার নির্দেশিত পথে চলার মতো শিষ্য তো ইচ্ছা করলেই হওয়া যায়। আসলে, এখন গুরুদেব দেহে নেই, তাই সেই ধরণের শিষ্যদের আর দায়ও নেই। তিনি যদি আশ্রমে থাকতেন, এদের দেখলে মনে হতো- এই সব ভক্তরা থাকলে শ্রীগুরুর আর কী ভাবনা! এরাই তার আদর্শকে ছড়িয়ে দেবে দেশে-দেশান্তরে। আজ কোথায় তারা?
বাবাজী মহারাজ লিখছেন – জপ করতে হবে। ভগবান ভগবান বলে লোকের কাছে বলে বেড়িয়ে
লাভ নেই। জপ করতে হবে। নিয়মিত। নির্দিষ্ট পরিমানে। এমন অনেক লোক আছেন, যারা কুক্রিয়া করে না, কিন্তু
কুচিন্তা করে। কুচিন্তাকে প্রশ্রয় দিলে পাপের আর বাকী রইল কী?
এখন দেখা যাক শিষ্য কাকে বলে – শাস্ত্র বলছে - যিনি নিষ্কপট ভাবে গুরুকে ভক্তি করেন, গুরু ও ভগবানে ভেদ জ্ঞান করেন না, যিনি নিজের জ্ঞান বুদ্ধি কোন কার্যে প্রয়োগ করেন না, যিনি শূন্য মস্তিষ্কে গুরুর নিকট ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস এর সহিত জ্ঞান লাভ করেন এবং গুরুর আজ্ঞা পালন করেন তাহাকে শিষ্য বলে।
"আরুণি-নামেতে শিষ্য ছিল অন্য জন।
ডাকি তারে গুরু আজ্ঞা কৈল ততক্ষণ।।
ধান্য-ক্ষেত্রে জল সব যাইছে বহিয়া।
যত্ন করি আলি বাঁধি জল রাখ গিয়া।।
আজ্ঞামাত্র আরুণি যে করিল গমন।
আলি বাঁধিবারে বহু করিল যতন।।
দন্তেতে খুঁড়িয়া মাটি বাঁধালেতে ফেলে।
রাখিতে না পারে মাটি, অতি বেগ জলে।।
পুনঃ পুনঃ শিষ্যবর করিল যতন।
না পারিল ক্ষেত্রজল করিতে বন্ধন।।
জল বহি যায়, গুরু পাছে
ক্রোধ করে।
আপনি শুইল শিষ্য বাঁধাল উপরে।।
সমস্ত দিবস গেল, হইল রজনী।
না আইল শিষ্য, গুরু চলিল
আপনি।।
ক্ষেত্র মধ্যে গিয়া ডাক দিল দ্বিজবর।
শিষ্য বলে, শুয়ে আছি বাঁধের উপর।।
বহু যত্ন করিলাম, না রহে বন্ধন।
আপনি শুলাম বাঁধে তাহার কারণ।।
শুনিয়া বলিল গুরু, এস হে উঠিয়া।
শীঘ্র আসি গুরু পায় প্রণমিল গিয়া।।
শিষ্যেরে দেখিয়া গুরু আনন্দিত মন।
সঙ্গে করি নিজ গৃহে করিল গমন।।
আশিস্ করিয়া গুরু করিল কল্যাণ।
চারি বেদ, ষট্ শাস্ত্রে হোক্ তব
জ্ঞান।"
বিনয়ী, নম্র শিষ্য হল সে, যে শিষ্য পারমার্থিক দীক্ষাগুরুর নির্দেশ
শ্রদ্ধা সহকারে প্রতিপালনে জীবন উৎসর্গ করে। শিষ্যের সবসময়ে উচিত -গুরুর প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে তার দেখানো প্রণালীতে ঠিকমত জপ ধ্যান এগিয়ে
নিয়ে যাওয়া। তার আদর্শ পালন করে জীবন পথে চলা - তবেই
সার্থক হয় গুরু শিষ্যের অমৃতের পথে যাত্রা।
মনে রাখবেন -গুরু ইষ্টের মধ্যে অভেদে প্রকাশমান থাকেন। দীক্ষার পর গুরুমুখী ভাবার্থের দ্বারা শিষ্যের মধ্যে যদি ওই ইষ্টের প্রকাশ হয়, তখন গুরু যদি ইষ্টমন্ত্রটি শিষ্যের কাছ থেকে দক্ষিণাস্বরূপ ফেরৎ চান, শিষ্য যদি তা প্রত্যার্পণ করে, তাহলে তিনি শিষ্যকে গুরুতে লয় করে নেন। এর ফলে গুরু ঋণ শোধ করা যায়। কিন্তু যে সব শিষ্য ইষ্টমূর্তিতে লয় হয় না, তারা গুরুর কাছে চিরকাল ঋণী থাকে এবং গুরুর আসল কর্ম করতে সমর্থ হয় না।