বাবাজী মহারাজ মনে করতেন সুস্থ মানুষ গঠনের শর্ত সংযম, শরীর, অন্ন-বস্ত্র ও শিক্ষা

 


শ্রীগুরু লাটাই হাতে অন্তরালে থেকে আমাদের দেখেন আর হাসেন। হয়তো ভাবেন, ‘ওর যতক্ষণ না পাখা ক্লান্ত হয়, যতক্ষণ না কোন বিপদ আসে, উড়ে যাক। লোভের খোলা আকাশে উড়তেই থাক।আমরা তখন হয়ে যাই, বাসনা, কামনার উদগ্র দাস। তারাই তখন আমার পিতা-মাতা-গুরু। বোধ তখন হারিয়ে যায়, চেতনা মিলিয়ে যায়, কামনার উষ্ণতায়। 

 

তারক ঘোষ


বাবাজী মহারাজ মনে করতেন, আগে শরীর, তারপর ধর্মশরীরং আদ্যং খলু ধর্ম সাধনং আর শরীর রক্ষা করতে বাবাজী গুরুত্ব দিতেন সংযমের উপর সংযম অভ্যাস করতে পারলে ষড়রিপু কাউকে বিপদে ফেলতে পারে না অন্যের উন্নতি দেখে মানুষের লোভ পরশ্রীকাতরতা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন তার সংযম থাকে না এই কারণে, বাবাজী সংযমকে জীবন গঠনের মূল্যবান উপদান মনে করতেন আর এর সঙ্গে আর একটি দোষ ত্যাগ করার কথা বলতেন সেটি হলো আলস্য কারণ, আলস্য মানুষের এগিয়ে যাওয়ার  পথে আর একটি বড় বাধা

বাবাজী বলতেন, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে ভোগ, তার শুরু ও শেষ আছে, তাই এই ইন্দ্রিয়ভোগের দ্বারা মানুষের জীবনে কখনোই শান্তি আসতে পারে না। ভোগ করতে করতে, একটা সময় আসবে হতাশা। আর এই হতাশা থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজতেই তখন মানুষকে ফিরতে হবে সেই সুপ্রাচীন পথে, যে পথ আমাদের নিয়ে যাবে পরমশান্তির দিকে। জপ, ধ্যান ধর্মীয় ব্যাপার শুধু নয় এর মধ্যে আছে বিজ্ঞান। আর জপ ও ধ্যানের মাধ্যমে মানুষ খুঁজে পাবে জীবনের পরম শান্তি।


 

বাবাজী চেয়েছিলেন আগে দেশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হোক আর এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভের প্রথম ধাপটাই হল শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য। সমাজের প্রতিটি মানুষ যাতে সুশিক্ষিত হয়, এটাই ছিল তার সাধনা। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন না হতে পারলে সুস্থ সমাজ গড়ে উঠে পারে না। সুস্থ সমাজ গঠনের চাবিকাটি হলো, প্রতিটি মানুষের রোজগার। তাই তিনি বলেছিলেন, যে মানুষকে প্রতিটি দিন সকালে উঠে ভাবতে হয়, কীভাবে দিন চলবে, মাথায় ছাদ নেই, ঘরে ভাত নেই, ব্যাঙ্কে টাকা নেই, হাতে রোজগার নেই, তাকে কীভাবে ধর্মকথা বলবো! সে নেবেই বা কেন? আগে তাই দরকার মানুষের রোটি-কাপড়া ঔর মকান, উসকে বাদ সবকুছ।

সঠিক জীবন গড়তে তিনি তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন প্রথমটি হলো সংযম, সংযম অভ্যাস করতে পারলে মানুষ পাপের পথে এগোতে পারে না দ্বিতীয়টি হলো কর্ম কেননা কর্মই মানুষকে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যায় আর শেষটি হলো লক্ষ্য স্থির করা লক্ষ্য স্থির না হলে সংসার জীবন বা ধর্মীয় জীবন পথচ্যূত হয় আর ব্যাপারে পিছুটান যেন বাধা হতে না পারে, সে ব্যাপারেও বাবাজী মহারাজ লক্ষ্য রাখতে বলেছিলেন উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, নোঙ্গরে আটকে থাকা নৌকো কোনদিনই দাঁড় বেয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না যেখানে প্রথমে ছিল, সেখানেই থেকে যায় সেই রকম অন্য কোন বিষয়ে আসক্ত হয়ে যে যত কাজই করুক না কেন, সেই কাজ কোন ফল দিতে পারে না জীবনকে অসত্য থেকে সত্যের দিকে নিয়ে যেতে হবে কর্ম পরিত্যাগ না করে, সৎ কর্মের দিকে নিজের ভাবনা কাজের অভিমুখ ঠিক করতে হবে

স্বামী প্রজ্ঞাদাসজী মহারাজ ছাত্রসমাজকে তাই বেছে নিয়েছিলেন  উন্নততর সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ হিসাবে। তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমাদের কাজ হবে দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা। আর দেশকে গড়ে তুলতে হলে প্রথমে দরকার একতাবদ্ধ হওয়া আর দ্বিতীয় কথা হলো অশিক্ষা দূর করা। একটা মানুষও যেন শিক্ষার আলোর বাইরে না থাকে। প্রতিটি বাড়িতে অন্ন, সুস্বাস্থ্য আর শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে- এটাই উন্নততর দেশ গঠনের প্রথম শর্ত।

তিনি বলেছিলেন, এই দায়িত্ব নিতে হবে ছাত্রসমাজকেই। এটার দিকে লক্ষ্য রেখেই তারা বড় হয়ে উঠবে।  এটাই ছিলেন আমাদের বাবাজী। উন্নতসমাজের প্রথম শর্ত দুটি হলো শিক্ষা আর অন্ন সেটা তিনি বুঝেছিলেন।

আমরা বহু ভুল করি, মিথ্যা বলি। এক ভুল আর মিথ্যাকে ঢাকতে গিয়ে আসে হাজার ভুল, হাজার মিথ্যা। সরে যেতে থাকি সত্যের আলোক থেকে অনেক অনেক দূরে। যখন সব মিথ্যা শেষ হয়ে যায়, দেখি, একা দাঁড়িয়ে আছি কোন সুগভীর খাদের কিনারায়। আমাদের পাশে কেউ নেই। 

যাদের জন্য ভুল করেছি, মিথ্যা বলেছি, তারা সময়মতো তাদের স্বার্থ পূরণ করে কেটে পড়েছে। আর আমরা আছি একা। দস্যু রত্নাকর হয়ে। বাল্মীকি হতে পারি নি।

তখনো যদি, আমরা সেই ভুলকে চিনতে চেষ্টা না করি, কিংবা মিথ্যার আড়ালেই আশ্রয় নিই, তাহলে আমরা আর কোনদিন সত্যের সামনে দাঁড়াতে পারবো? ভয় লাগবে সত্যকে। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার মতো মেরু্দন্ডের জোর থাকবে না। জীবন হয়ে উঠবে বিষময়। তখন, আমাদের সেই একাকীত্বের মাঝে থাকেন আমাদের গুরুদেব। কেন থাকেন জানেন? 

আসলে, যে মুহুর্তে আমরা তার কাছে নিজেদের নিবেদন করে ফেলি, সেই মুহুর্তে আমাদের রক্ষাকর্তা হয়ে তিনি আমাদের পাশে থাকেন। লাটাই তো তার হাতে। ঘুড়ি যতই উচ্চে যাক না কেন! হয়তো ভাবছেন, আমরা যখন ভুল করি, তখন গুরুদেব আমাদের বাধা দেন না কেন? 

আমি দেখেছি, আমরা খারাপ কাজ করার আগে শ্রীগুরু নানারূপে আমাদের বাধা দেনকেউ না কেউ আমাদের সেই কাজ করতে নিষেধ করেন, যে কাজে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমরা তখন তাকে চিনতে পারি না। কিংবা, মোহের বশে পরিণামের কথা না ভেবে আমরা এগিয়েই যাই, যতক্ষণ না বিপদ আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। 

লোভ আর মোহ এই দুইয়ের টান অগ্রাহ্য করার মতো মানুষ খুব কম। তাই আমাদের বিপথে চালিত করার জন্য, লোভ আসে। নানা রূপ ধরে। মোহময়ী নারী, পুরুষ, বেআইনি অর্থ-সম্পত্তির রূপ নিয়ে। আমাদের দুকানে তখন ঢোকেনা গুরুদেবের নিষেধাজ্ঞা, আমাদের দুচোখে ভাসে না শ্রীগুরুর বরাভয় মূর্তি, আমাদের মস্তিষ্কে থাকে না শ্রীগুরুর পদপদ্ম। 

আমাদের জিভে উচ্চারিত হয় না, শ্রীগুরুর দেওয়া মন্ত্রধ্বনি। আমাদের কান শুধু শোনে প্রিয়-প্রিয়া বা প্রতারকের মধুর ভাষণ, আমাদের চোখ জুড়ে থাকে লালসা, আমাদের মস্তিষ্কে থাকে একরাশ অলীক বাসনার স্বপ্ন, আর আমাদের জিভে আসে শুধু –‘দাও মোরে আরো দাও।

শ্রীগুরু লাটাই হাতে অন্তরালে থেকে আমাদের দেখেন আর হাসেন। হয়তো ভাবেন, ‘ওর যতক্ষণ না পাখা ক্লান্ত হয়, যতক্ষণ না কোন বিপদ আসে, উড়ে যাক। লোভের খোলা আকাশে উড়তেই থাক।আমরা তখন হয়ে যাই, বাসনা, কামনার উদগ্র দাস। তারাই তখন আমার পিতা-মাতা-গুরু। বোধ তখন হারিয়ে যায়, চেতনা মিলিয়ে যায়, কামনার উষ্ণতায়। 



আর যুক্তি? 

যুক্তি তখন লোভের কানাগলিতে ঘুরে বেড়ায়। ভক্তের এমতাবস্থাতেও শ্রীগুরু থাকেন তার পাশে, পরীক্ষা নিতে থাকেন, কখন ভক্ত-শিষ্য তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে তাকে একবার ডেকে উঠবে। একেবারে অন্তর ভেদ করে সেই ডাক উঠে আসবে, কানে বাজবে শ্রীগুরুর বাণী, চোখে বইবে অনুতাপের বারিধারা, হৃদয় শুধু কান্নার শব্দ আর মস্তিষ্ক জুড়ে থাকবে, সত্যের আলোর দাপাদাপি। তখন আর পারবেন না শ্রীগুরু দূরে থাকতে। তাকে তখন আসতেই হবে।  

 

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad