ধর্ম, কর্ম ও সমাজ – এই তিন বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে বাবাজী মহারাজের জীবন ও দর্শন


 

নিজের জীবন গোছানোর জন্য তিনি সন্ন্যাসী হন নি, বরং নিজের জীবন দিয়ে তিনি সেবা করেছেন মানুষের। তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন বারে বারে। তিনি দেহে না থাকার ফলে, অবস্থা আবার যা কে তাই। তার জায়গা পূরণ করার মতো যোগ্য সাধু কে আছেন? তার উত্তর একমাত্র সময় দেবে।

তারক ঘোষ

 কুসংষ্কারমুক্ত ও সুস্থ সমাজ ছিল বাবাজীর স্বপ্ন। সংবাদ ভয়েস ৯ - এর এই নিবন্ধ সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। আমাদের এই লেখা পৃথিবীর প্রায় ১৪ টা দেশের ২ লক্ষাধিক পাঠক নিয়মিত পড়েন। এদের মধ্যে সবাই কিন্তু বাবাজী মহারাজের শিষ্য নন। তারা জানতে চান আমাদের বাবাজী সম্পর্কে।

এখনকার দিনে বেশিরভাগ সাধু-সন্ন্যাসীরা আর সমাজের বাইরে নন। এই সমাজের মধ্যেই তারা বাস করেন – বনে বা বা হিমালয়ের বরফে আচ্ছন্ন গুহায় তাদের অধিকাংশই থাকেন না। বাস করেন অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত আশ্রমে, দামী গাড়িতে চড়েন, আকাশপথে প্লেনে চড়ে যাতায়াত করেন। ত্যাগ বলতে পূর্বাশ্রমের নাম আর বিবাহ না করা। আবারও বলছি, সবাই নন। একশ্রেণির ‘সাধু-সন্ন্যাসী’ – যারা অত্যাধুনিক ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, এটিএম ব্যবহার করেন, জনগণের দানে যাপন করেন বিলাসী জীবন। এরকম বহু ‘সাধু’ নামধারী ব্যক্তি তো কোটি কোটি টাকা ও সম্পত্তির মালিক হয়ে বসে আছেন। সবই ভক্তদের টাকা – কোনোটা সাদা, কোনোটা কালো। এমনকি এদের জীবনে নারীও থাকে।



শুধু নারী থাকলেও বা কথা ছিল। অনেকে আবার আরো এগিয়ে নারী ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গেও যুক্ত বলেও অভিযোগ উঠেছে। সেইসব ‘বাবা’রা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খাটছেন। কেউ বা আশ্রমের সম্পত্তি হাতানোর জন্য খুন করে জেলেও গেছেন। কেউ বা অপরাধ করে ধরা পরার ভয়ে আত্মহত্যাও করেছেন। সংবাদপত্রে তার অসংখ্য খবর আপনারা প্রায়ই দেখতে পান। বহু আশ্রমে নারীদের উপর সেক্সুয়াল টর্চার ও ডিজিট্যাল রেপের অভিযোগও উঠেছে। এমনকি নারী ভক্তদের সেক্স স্লেভ হিসাবে ব্যবহার করার অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশের কাছে। আদালতে মামলাও চলছে, এরকম বহু অভিযোগের।

বহু চোর-ডাকাতও পুলিশের হাত থেকে পালানোর জন্য অনেক সময় সাধুর বেশ ধরে লুকিয়ে থেকেছে বহু বছর। তবে শেষ রক্ষা হয় নি। জেলে যেতেই হয়েছে তাদের। কারণ, ভগবানের সিসিটিভি সারভিলেন্সের মধ্যে যে সকলেই আছেন, এটা তারা বুঝতে  পারে নি। তাই গোপনে করা পাপ যে ভগবানের সিসিটিভি কন্ট্রোলরুমে ধরা পড়ছে ও রেকর্ড হয়ে থাকছে, এটাই অনেকে বোঝেন না। কাকে ফাঁকি দেবে? ভগবানকে?


এদের কেউ নাবালিকার শ্লীলতাহানীর অভিযোগে, কেউ খুনের অভিযোগে, কেউ অপরাধ করে সাধু সেজে লুকিয়ে থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিল।

যে সাধুরা এই সমাজের অর্থে প্রতিপালিত হন, সমস্ত সামাজিক সুবিধা ভোগ করেন – সমাজের প্রতি তাদের একটা দায়িত্ব আছে বলে বাবাজী মহারাজ মনে করতেন। সমাজ গঠন করা তাদের একটা কাজ। মানুষের জীবন গঠন, সমাজ থেকে হিংসা, হানাহানি বন্ধ করা, মানুষকে কুসংষ্কারমুক্ত করা – একজন সাধুর জরুরী কাজ বলে বিশ্বাস করতেন আমাদের বাবাজী মহারাজ। আর তাই, তার সারাটা জীবন আবর্তিত হয়েছে কর্ম, ধর্ম ও সমাজের জন্যই। তিনি ছিলেন সংষ্কারক - ধর্মের ও সমাজের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক সংষ্কার সাধন করে এক নতুন ধর্মীয় ও সামাজিক বিন্যাস করতে চেয়েছিলেন। এর ফলে, এই একবিংশ শতাব্দীতে আর একটা ধর্মীয় ও সামাজিক নবজাগরণ ঘটতে পারত।

মহাপ্রভু ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব বাংলার নবজাগরণে জ্বালিয়েছিল এক আগুনের শিখা। তদের লোকশিক্ষা মানুষকে পরিশোধিত হবার রাস্তা দেখিয়েছিল। আর ভক্ত বীর-সন্ন্যাসী বিবেকানন্দশ্রীরামকৃষ্ণের  দেখানো পথকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন জ্ঞানের আলোয়; ঠিক তেমনি স্বামী জানকীদাসজী ও বাবাজী মহারাজও এসেছিলেন লোকশিক্ষা দেওয়ার জন্য। সমাজ ও ধর্মের মধ্যে যে গ্লানি লুকিয়ে আছে – সেই গ্লানি দূর করার জন্য।

তাই সাধু সমাজের মধ্যে একশ্রেণির ‘সাধু’দের পাপাচারের বিরুদ্ধেও তারা প্রতিবাদ করেছেন। বাবাজী মহারাজ মিডিয়ার সামনেও এই সামাজিক অনাচারের কথা বারংবার তুলে ধরেছেন। আর এখানেই তার সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য। তিনি সন্ন্যাসী হয়ে সমাজে থেকে সামাজিক দায়িত্বের কথা ভুলে যান নি। তাই কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র পিতার কাছে সাহায্য পাঠিয়েছেন। দরিদ্র শিল্পীদের জীবন-সংগ্রামের পাশে থেকেছেন। সাদাকে সাদা বলেছেন, কালোকে কালো। ঠিক দাদাজী মহারাজের মতোই। বাবাজী একজায়গায় তার শ্রীগুরু প্রসঙ্গে বলছেন  যে কোন কাজ তিনি ধরতেন, তা শেষ না করে ছাড়তেন না। এটা ছিল তার বাহ্য ব্যবহার। লোকচক্ষুর আড়ালে কতভাবে কত ভক্ত শিষ্যের অধ্যাত্ম উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত করতেন, তার সব খবর কারো জানা নেই। 


নিজের জীবন গোছানোর জন্য তিনি সন্ন্যাসী হন নি, বরং নিজের জীবন দিয়ে তিনি সেবা করেছেন মানুষের। তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন বারে বারে। সমাজটাকে নতুনভাবে গড়ে তুলে এক নয়া ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কটা ‘সাধু’র মধ্যে এই শিক্ষা, সমাজ-ভাবনা আমরা আজ দেখতে পাই? হাতে গুণে বলে দেওয়া যাবে।

কর্মের মধ্যে সংষ্কার, ধর্মের সংষ্কার ও সমাজ সংষ্কার – এই ছিল তার জীবনের ব্রত। আর তিনি এই শিক্ষাই লাভ করেছিলেন তার শ্রীগুরু শ্রীজানকীদাসজী মহারাজের কাছ থেকে। জীবন থেকে, সংসার থেকে পালিয়ে তিনি সন্ন্যাসী হন নি। জীবনের মধ্যে থেকেই, সংসারের মধ্যে থেকেই তিনি সংষ্কারে মন দিয়েছিলেন।


সাংবাদিক হিসাবে ভারতের নানা ধর্মীয় মেলায় যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে আমি সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখেনি, ধর্মীয় চোখ ও আবেগ দিয়ে তাদের মেলায় থাকাকালীন সময়কে আমি মাপিনি। সেইসময় ভারতের এক নামী ইংরাজী কাগজের একজন সিনিয়র ক্রাইম জার্নালিস্ট হিসাবে নজর রেখেছি তাদের তাঁবুতে তাঁবুতে। কখনো কুম্ভে, কখনো সাগরে, কখনো জয়দেবে, কখনো সতীমায়ের মেলায়। দেখেছি একশ্রেণির ‘সাধু’দের লীলা। সন্তান কামনায় আসা রমনীদের সঙ্গেও তাদের অশালীন আচরণ আমার চোখের বাইরে যায় নি। ফলে, সাধু সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা আমার ছিল না। কারণ, যে আমরা প্রকৃত সন্ন্যাসীর জীবন কাহিনি পড়ে বড় হয়েছি, তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড দেখেছি, সেখানে এগুলোকে মেলাতে পারি নি। কিন্তু, বাবাজী মহারাজের দর্শন পাওয়ার পর আমি বুঝি, ওই ‘কলঙ্কিত সাধু’দের বাইরেও আছেন সেইসব মহান সাধকরা যারা কাজ করে চলেছেন, সবার অলক্ষ্যে। বদলে যায় আমার দৃষ্টিভঙ্গী।



বাবাজী মহারাজ মনে করতেন, শুধু নেওয়া নয়, বিনিময়ে সমাজকে দেওয়াটাও তাদের কাজ। কিন্তু, তারা কী দেবেন?

তার আদর্শ। তার জ্ঞান। যা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার ভক্ত-শিষ্যদের মাঝে। নিয়েছেন ক’জন? জানি না। জানতে চাইও না। কারণ, তিনি দেহে না থাকার ফলে, অবস্থা আবার যা কে তাই। তার জায়গা পূরণ করার মতো যোগ্য সাধু কে আছেন? তার উত্তর একমাত্র সময় দেবে।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad