শ্রীবাবাজী মহারাজ ধর্মের মধ্যে মানুষকে নিমজ্জিত করে রাখতে চাননি। বরঞ্চ ধর্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে, মানুষকে কর্মের মধ্যে নিমজ্জিত করতে চেয়েছিলেন। সেই কর্ম ফলের আশা করে না, কিন্তু সংসার জীবনে থেকেও পৌঁছে দিতে পারে বন্ধনহীন আনন্দের হাটে।
তারক ঘোষ
টেবিলের উপর আধ-গ্লাস জল বসিয়ে রেখে যদি
আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘কী দেখছেন?’
এই প্রশ্নের উত্তরে আপনাদের মধ্যে কেউ
বলবেন, ‘গ্লাসটার অর্ধেক খালি’, কেউ বা বলবেন, ‘গ্লাসটার অর্ধেক ভর্তি।‘ নিঃসন্দেহে
ওই দুটো উত্তরই সঠিক। কিন্তু, এই দু রকমভাবে দেওয়া উত্তর থেকে দু রকমের মানসিকতা সম্পন্ন
মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়। একশ্রেণির মানুষ গ্লাসের অর্ধেকটা খালি দেখেন, এরা ঋণাত্মক
মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ। আর যারা অর্ধেকটা ভর্তি দেখেন তারা ধনাত্মক মানসিকতা সম্পন্ন।
আমাদের সমাজে এই দু ধরণের মানুষ দেখা যায়। বাবাজী মহারাজ এদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন এবং
কীভাবে ধনাত্মক পথে চলতে হবে তার উপায়ও বলে গিয়েছিলেন। ধনাত্মক মানসিকতার মানুষ কখনো
ভেঙ্গে পড়েন না, বিপদ এলেও তারা উদ্ধার পেয়ে যান। এরা কখনো দুঃখে বিচলিত হন না। এরা
কারও ক্ষতি করেন না, বরং পারলে উপকার করার চেষ্টা করেন।
অনেকেই জানেন, পরচর্চা বেশ মুখরোচক ব্যাপার,
অনেকটা শেষ পাতে আচার খাওয়ার মতো – টক-ঝাল-মিষ্টি। ইচ্ছে হলেও নিজেকে সামলানো যায় না,
তাই অনেকে ‘খাব খাব না’ করেও, একটু মুখে ফেলে দেন। আর পরনিন্দা হলো, ঠিক চাটনির মতোই।
করব না, করব না করেও ঠিক জমিয়ে বসে যাই অন্যের নিন্দায়। আগে মনে করা হতো, শুধু মেয়েরাই
বোধহয়- এই কাজে পটু। এখন দেখি, ছেলেরাও কম যায় না। ট্রেনে অফিসযাত্রীদের যদি দেখেন,
এদের পুরো যাত্রাপথটাই চলে অন্যের আলোচনায়, নিন্দায়। গঠনমূলক আলোচনা বা সমালোচনা কিন্তু
পরচর্চা নয়। পজিটিভ ক্রিটিসিজমকে পরচর্চার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। তাহলে পরনিন্দা
কোনগুলো?
আপনি শুনলেন এক মহিলা তার সঙ্গী এক মহিলাকে
বলছেন, “শুনেছেন, অমুকবাবুর মেয়েটা এখন রাত করে বাড়ি ফেরে। সেদিন রাতে দেখি, একটা টোটোতে
ফিরছে, সঙ্গে কত প্যাকেট।“
অপর মহিলা বললেন, “ও, কৃষ্টির কথা বলছিস?
শুনলাম, ও একটা কর্পোরেটে কাজ করে, ভালো পোস্টে।“
আগের মহিলা বললেন, “রাখুন ওসব কথা। চাকরি
না ছাই। কোথায় কার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে টাকা কামাচ্ছে।“
আগের জন বলেন, “কার সঙ্গে কার তুলনা,
আপনার মেয়ে বুলাতো ভীষণ লক্ষী।“
এই হলো পরনিন্দা। এরা কেউ সত্যটা জানেন
না। তার আগেই পাশের বাড়ির এক কন্যাসমা মেয়ের নামে নিন্দা করতে এদের বাধে না। আবার আশ্চর্য্য
কী জানেন। আগের মহিলার সঙ্গে যখন কৃষ্টির মায়ের দেখা হবে, তখন ওনার মুখে ফুটবে বুলার
মায়ের নামে নিন্দা।
এই শ্রেণির মানুষরা সমাজের পক্ষে ভীষণ
বিপজ্জনক। আমাদের চারপাশে এই ধরণের বহু মহিলা আছেন, কিছু মধ্য-বয়স্ক পুরুষ আছেন, যারা
এই ধরণের কথায় মেতে থাকেন। এক কান থেকে অন্য কানে পৌঁছে দেন। ক্ষতি করতে থাকেন অন্যের।
এরা কোনদিনই সত্য খুঁজবে না, বরং সত্যকেও রঙ চড়িয়ে মিথ্যে করে তুলবে। এদের দশচক্রে
ভগবানকেও ভূত হয়ে যেতে হয়।
এরা বহন করে নেগেটিভ শক্তি। এদের আশেপাশে
যারা থাকেন বা মেশেন, তারাও এদের নেগেটিভ শক্তির ফাঁদে ধরা পড়ে যান। কারোর পজিটিভ এনার্জিও
এদের সংস্পর্শে নেগেটিভ শক্তিতে পরিণত হয়ে যেতে পারে। একশ্রেণির যুবক আছেন বা পড়ুয়া
আছেন, যারা নিজেরা ঠিকঠাক পড়াশুনো না করে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে বাবা-মার কাছে বলে,
এই রাজ্যে কিছু হবে না। কোথাও চাকরি নেই। ভবিষ্যতের রাস্তা বন্ধ। এরা আসলে নেগেটিভ।
ভালোভাবে সঠিক রাস্তায় পড়াশুনো করে, ইংরাজী ভাষাকে ভালোভাবে রপ্ত করে কেউ যদি চাকরির পরীক্ষা দেয়, সে পেতে পারে। বহু কেন্দ্রিয়
চাকরি আছে, ঁউচু পদের চাকরি আছে, কর্পোরেটে যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীরা চাকরি পায়।
এরা যোগ্যতা অর্জন না করে, স্কিল না বাড়িয়ে, ইংরাজী না শিখে ‘চাকরি নেই’, চাকরি নেই’
করে বলে বেড়ায়। এরাই বিপদে পড়ে। নিজেরাও চাকরি পায় না, অন্যদেরও নেগেটিভ মানসিকতা সম্পন্ন
করে দেয়। শেষে ক্ষতি হয় সমাজের।
কেউ যদি মাস্টারস করে পিওনের চাকরির যন্য
দরখাস্ত করেন, তাহলে ক্ষতি করা হয়, নীচু পোস্টের দাবিদারদের। তাই যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি
খোঁজা দরকার। আর ছাত্র জীবনে মোবাইল আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সময় কাটিয়ে দিলে তাদের ভবিষ্যতটাই
নেগেটিভ হয়ে যায়। তাই যারা ‘নেই নেই’ করে, তাদের সঙ্গ এড়িয়ে চলাটা আজকের দিনে খুব জরুরী।
একশ্রেণির মানুষ আছেন, যারা সৎ উপায়ে
অর্জিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বাড়ি-গাড়ি করেন। কিন্তু আর এক শ্রেণির মানুষ আছেন,
যারা এর পিছনে ঘুষের ইঙ্গিত দিয়ে নানা জায়গায় রটিয়ে বেড়ান। বাস্তবে, দেখা যায় এর ঠিক
উলটো ছবি। আসলে, যে যেমন মানুষ, সে ঠিক সেরকমটাই ভাববে।
পজিটিভ মানুষরা এই শ্রেণির মানুষকে এড়িয়ে
চলেন, এমনকি আত্মীয় হলেও। কারণ, আত্মীয়দের মধ্যে এরকম প্রচুর মানুষ থাকেন, যারা সবসময়
আত্মীয়দের মধ্যেও তাদের নেগেটিভ ভাবনাকে ছড়িয়ে দেন। এদের এড়িয়ে চলা উচিত। আর এই সব
থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো – পরনিন্দা ও পরচর্চা বন্ধ করা। নইলে। অন্যের পাপ, বা
দোষ- যাই থাকুক না কেন, আপনাকে স্পর্শ করবেই। অন্যকে বলা কথা আপনার জীবনেই ফিরবে –
আজ, না হয় কাল।
বাবাজী মহারাজ তাই বলেছিলেন, যারা পরনিন্দা-পরচর্চা
করেন, অন্যের দোষ দেখেন, তারা নিজেদের অজান্তে
অন্যের দোষগুলো নিজের মধ্যেই টেনে আনেন। বাবাজী বলছেন, আজ সংসারের নানা কর্মে আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে
খুঁজে পাচ্ছি না। যেদিন এই নিজেকে খুঁজে পাবে, নিজের আত্মাকে খুঁজে পাবে, বুঝতে পারবে, তিনিই তোমার শিক্ষক। তখন প্রত্যেকটা পদক্ষেপে আর ভুল হবে
না।
শ্রীজানকীদাসজী, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বাবাজী মহারাজ বলেছেন – বিপদ ভিতর থেকেই আসে। কাজেই দুঃখ বাইরে থেকে আসে না। দুঃখের
অনুভূতি ভিতর থেকেই আসে। আর এই ‘আসার’ কারণ হলো, দুঃখ আমরা পেতে চাই। কিন্তু, দুঃখকে যদি পেতে না চাই, তাহলে দুঃখ এলেও কষ্ট না দিয়েই ফিরে
যাবে।