‘আমি’ নয়, ‘আমিত্বের’ বিনাশ দরকার। ‘আমি’ টা কে? আপনার দেহ? না আপনার আত্মা? আর ‘আমিত্ব’ই বা কী, সেটাই আগে জানা প্রয়োজন।

 



নাম পাল্টানোটা কোনো বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার হলো নিজেকে পালটানো যদি কেউ  সর্বত্যাগী হয়ে নাম পাল্টান, তাকেও কিন্তু, দেশের আইন মেনেই চলতে হয় এই পার্থিব নিয়মে তিনি বাঁধা থাকবেন, অর্থাৎ তার দেহ বাঁধা থাকবে দেশের নিয়মে, আর তার শুদ্ধ অন্তরাত্মা যুক্ত থাকবে পরমাত্মার সঙ্গে একদিকে তার দেহ বদ্ধ জাগতিক নিয়মে আর তার আত্মা মুক্ত কাজেই নাম আত্মার সঙ্গে যুক্ত নয়, যুক্ত দেহের সঙ্গে

 

তারক ঘোষ


এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের একটা নাম থাকে নাম একটা মানুষ থেকে আর একটা মানুষকে পৃথক করে, অর্থাৎ এই নাম একটা মানুষের প্রাথমিক পরিচয় নামকে বাদ দিয়ে কোন দেশে বাস করা সম্ভব নয় আর নাম এর বদলে নম্বর দিয়ে যেহেতু এখনো কোনো দেশে মানুষকে আলাদা করা হয় না, তাই নাম থাকবেই সেটা মানুষেরআমিএর নাম হোক, কিংবা তার দেহের নাম হোক আর এই নাম বদলালে মানুষটা বদলে যায় না, বায়োমেট্রিক তথ্য দিয়ে তাকে চিহ্ণিত করা সম্ভব

নাম অনেকেই বদলে ফেলেন সামাজিক কারণেই হোক, বা অপরাধ করার কারণেই হোক কিংবা আধ্যাত্মিক কারণেই হোক সাংবাদিক হিসাবে আমি বহু অপরাধী, খুনীদের দেখেছি তাদের তিন চারটে নাম আছে পুলিশের খাতায় শ্যামল ওরফে পটাই ওরফে হাতকাটা নাটাইএরকম বহু নাম বহু খুনী-ধর্ষণকারীও নাম বদলেসাধু ছদ্মবেশ ধরেনন্দকিংবাদাসসেজে লুকিয়ে থাকে কিন্তু, মানুষটা সেই একই তার অপরাধের ধরণ অর্থাৎ তার ক্রাইম করার স্পেশালিটি দেখেই পুলিশ অনেক সময় ছদ্মবেশী এই নাম বদলানো অপরাধীদের শনাক্ত করে ফেলে



যাইহোক যা বলছিলাম, নাম থাকতে হবেই দেশের আইন অনুসারে কেউ নিজেকে অন্য নামে পরিচিত করাতেই পারেন, ছদ্মনাম দিয়ে লিখতেই পারেন, কিন্তু, নাগরিকত্বের নিদর্শন হিসাবে, তার সমস্ত রেকর্ডই থাকবে, তার নাম, জন্মদাতা পিতা, স্থায়ী বাসস্থান ইত্যাদি অনুসারে যদি নাম বদলাতে হয়, তাকে আইন মেনেই নাম বদলাতে হবে, সেটার বিজ্ঞাপন দিতে হবে অর্থাৎ সকলকে জানাতে হবে, তিনি একসময় এই নামে পরিচিত ছিলেন, বর্তমানে  এফিডেভিট করে অন্য নামে পরিচিত হয়েছেন আর নাম পাল্টানোর কাগজপত্রও রাখতে হবে

কাজেই নাম পাল্টানোটা কোনো বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার হলো নিজেকে পালটানো যদি কেউ ধর্মীয় কারণে নাম পাল্টান, একইসঙ্গে প্রয়োজন তার অন্তরাত্মার শুদ্ধি, মনের কামনা-বাসনা ত্যাগ করে একটা শুদ্ধ আত্মায় রূপান্তরিত হওয়া নইলে নাম পালটে ফেলে, মনে হাজারো লোভ-বাসনা নিয়ে চললে, আখেরে নিজেকেই ঠকানো হয় সেকারণেই বাবাজী মহারাজ একজন লোভীসর্বত্যাগী চেয়ে একজন, নির্লোভ, সৎ গৃহী মানুষকে ঈশ্বরের কাছের মানুষ বলেছেন

অনেক ধার্মিক মানুষ বা যারা ধর্মপথে অগ্রসর হতে চান, তারা বলেন, আমিটাই খারাপ এই আমিথাকলে না কি ধর্মপথে এগনো যায় না  এটা পূর্ণরূপে ঠিক নয় বলেই আমি মনে করি কারণ, ‘আমিথাকবেই নইলে এই দেশে, সমাজে আপনি চলতে পারবেন না কিন্তু, এইআমিটা কে? আপনার দেহ? না, আপনার আত্মা? কেউ মারা গেলে বলা হয়, এটা অমুকবাবুর দেহ তাহলে, অমুকবাবুটা কে? নাম কার রাখা হয়? বাস্তবের আইনে নামটা থাকে দেহের আত্মার কোনো নামই হয় না তাকে সবাইআমিদিয়েও চিহ্ণিত করে 

এইআমিবোধটাই তার নিজস্ব চেতনার বোধ কাজেইআমিকে বাদ দেওয়া যায় না যেটা দরকার, তা হলোআমিত্বেরঅহঙ্কারকে বাদ দেওয়া কথাগুলো বলা খুব সহজ, কিন্তু, এই বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে তা পালন করা কয়েক কোটি মানুষের মধ্যে খানেক মানুষের পক্ষেই সম্ভব জীবন ত্যাগ করাও সোজা, কিন্তু, বাসনা ত্যাগ করা, অর্থ ত্যাগ করা? কটা গৃহী বাসাধুতা  পারেন? আসলে, এই পৃথিবীতে থাকতে হলে, পার্থিব আইন মানতেই হবে অর্থ না হলে কেউ এক পা চলতে পারবেন না কাজেই যিনি বলেন, অর্থ অনর্থের মূল, তিনি সত্য বলেন না  আসলে, বলা উচিত, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ, বা অন্যায় পথে উপার্জত অর্থই অনর্থের কারণ



আসলে, সবাই সাধু সাজতে চায় এখানে সা্ধু মানে একজন সৎ ব্যক্তির কথা বলে হচ্ছে কিন্তু সাধু সাজা সহজ, সাধু হওয়া সহজ নয়, তার জন্য এই সংসার জীবনেও ত্যাগের প্রয়োজন প্রয়োজন আমিত্বের বিনাশ আপনারআমিত্ব; আপনার বিপদের কারণ দাদাজী মহারাজ বাবাজী মহারাজ তাই বলতেন, বিপদ বাইরে থেকে আসে না, বিপদ আসে মানুষের অন্তর থেকে, মানুষের প্রবৃত্তিই মানুষকে টেনে নিয়ে যায় তার লক্ষ্যে

 বাবাজী মহারাজ, অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন তুমিত্ববাদে। আর একটি আমিত্বে বিশ্বাস করতেন - সেটি হল সূক্ষ 'আমি' - সদ, আনন্দস্বরূপ।  সকলকে তাই বলতেন, যদি ত্যাগ করতে হয়, তাহলে তোর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্থুল  আমিত্বটাকেই আগে ত্যাগ কর। দেখবি সব অহঙ্কার কোথায় চলে যাবে।


 
যে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আজ মন ভরে যাচ্ছে, মনের মধ্যে আমি করেছিবলে অহঙ্কার হচ্ছে, সেই বাড়ির দরজা দিয়েই তোকে একদিন চলে যেতে হবে চিরকালের জন্য। বাড়িটার মালিকানাও বদলে যাবে। একদিন সেই সাধের বাড়িটাও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। যেখানে তোর নিজের দেহটার মালিক তুই নয়, সেখানে কিসের আমিত্ব? 

কাজেই ত্যাগ, অতি কঠিন বস্তু আর আমিত্বত্যাগ আরো কঠিন। বাবাজী নিজে কোনদিন বলতেন না, ‘আমি দেখছি, আমি আশির্বাদ করছি, আমি আছি তোর জন্য। 



বাবাজীকে ভক্তরা যখন বলতেন, বাবা, ছেলেটার কিছুতেই শরীরটা সারছে না, আপনি ওকে আশির্বাদ করুন, যাতে সুস্থ হয়ে যায়। বাবাজী বলতেন, আমি ভগবানের কাছে নিবেদন করব। আসলে, ‘আমির একটাই কাজ, ভগবানের কাছে  সবকিছু নিবেদন করা। বাকিটা তিনি করবেন। 

কর্ম করা, কিন্তু ফল তাকেই অর্পণ করা। কিন্তু মনে রাখতে হয়, ঈশ্বর সেই ব্যক্তির কর্মফল, তাকেই ফিরিয়ে দেন। কাজেই মনে রাখবেন, কোন ধরণের কর্ম আপনি করবেন, কারণ, ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত ফলআপনার একাউন্টেই জমা থাকবে। সুদেও বাড়বে। নিতে আপনাকে হবেই।  আর একটা দিক আছে এই আমির। সেটা উপলব্ধি করা অতি কঠিন। এই আমির স্বরূপ সম্পর্কে কান্ট বলেছেন – Unknown and unknowable. বাবাজী লিখছেন, “এই আমিহল সৎসৎ শব্দের অর্থ হল অস্তিত্ববান। এটা চৈতন্যময়। এই আমিহল আনন্দস্বরূপ। এই আনন্দই কৃষ্ণ, এই আনন্দই আত্মা, এই আনন্দই দুর্গা। বিজ্ঞানের ভাষায় সবকিছুর মূল কারণ। 

 


যখন, এই আমি আনন্দ রূপে দেহে আবদ্ধ, তখন জীবাত্মা। আর যখন বিশ্বরূপে জগতে ব্যপ্ত, তখন পরমাত্মা। এই আমি নিজেই দ্রষ্টা, আবার নিজেই দ্রষ্টব্য।সোজা ভাষায় কর্তা ও কর্ম। খুবই জটিল বিষয়। যারা আমি তে বিশ্বাসী, তারা মনে করুন, আপনার আমিআর আপনি এক নন। 

বাউল সাধকদের কাছে এই আমি হল মনের মানুষ। যিনি তার মনের মধ্যেই প্রতিবেশীর মতোই বাস করেন, কিন্তু তার কাছে যাওয়া খুব কঠিন। তাদের কাছে এই মনের মানুষহল ঈশ্বর। আমরা সবাই জানি, যারা সাধু মানুষ বা যারা সন্ন্যাস অবলম্বন করেছেন, তারা সবাই ত্যাগী পুরুষঘর-সংসার, নিজের নাম, অভিমান, অর্থ সবকিছু ত্যাগ করে আসে পরমার্থ পাওয়ার বাসনায়। কারণ, বাবাজী বলতেন সাধকের কাছে ঈশ্বরপ্রাপ্তির সবচেয়ে বড় বাধা হল টান’ – সেই টান, একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া যেন, আর কিছুর প্রতি না থাকে   

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad