মনকে বশীভূত করার উপায় সম্পর্কে কী বললেন স্বামী শ্রীশ্রী জানকীদাস মহারাজ?

 



শ্রীশ্রী স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া মহারাজ লিখিত


শ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজ বলিতেন মনকে বশীভূত না করিতে পারিলে আধ্যাত্মিক উন্নতি হইতে পারে না। সংসারে বেশিরভাগ মানুষই মনের বশীভূত। মনের বশীভূত থাকিয়া অনেকে অনেক প্রকার কল্পনা করিতে থাকে কিন্তু মনকে জয় না করিলে অধ্যাত্ম জগতে কিছুই লাভ করা যায় না। মন জিতে সংসার জিতে। এই মনকে জয় করা এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। মনকে জয় করিবার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ এবং শক্তিশালী উপায় হইল জপ। প্রতিদিন নিয়মিত সময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যার জপ করিলে মন ধীরে ধীরে একাগ্র হইতে থাকে। ইহা ছাড়াও যোগশাস্ত্রে মনকে জয় করিবার আরও কয়েকটি পদ্ধতির কথা বলা হইয়াছে, সেগুলি নিম্নে আলোচনা করা হইল।




(১) বিষয়সুখ ভোগে বৈরাগ্যযতদিন পর্যন্ত আমরা সাংসারিক বিষয়ভোগকে সুন্দর এবং সুখপ্রদ বলিয়া মনে করি ততদিন পর্যন্ত আমাদের মন ঐ বিষয়ে সুখভোগে ধাবিত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ইন্দ্রিয় সুখভোগের মাধ্যমে যথার্থ শান্তি লাভ হয় না। পরিণামে দুঃখই পাইতে হয়। গীতায় শ্রীভগবান এই জগতটার সম্পর্কে বলিয়াছেন দুঃখালয়ং অশাশ্বতমশ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজ মাঝে মাঝে আমাদের বলিতেন—‘বুঝ, সংসারটারে ভাল করিয়া বুঝিয়া লও'। সংসারটাকে দুঃখময় বলিয়া অনুভব হইলে, ইন্দ্রিয়সুখলাভে তৃপ্তিলাভ হয় না জানিতে পারিলে মন তাহা হইতে সরিয়া আসে। পূর্বসংস্কারের বশে মাঝে মাঝে ইন্দ্রিয়ভোগের দিকে মন যাইলেও বুদ্ধিতে যদি বৈরাগ্যের ভাব থাকে তখন বুদ্ধি মনকে বোঝায় যে বিষয় কামনার পূরণ হইলেও শান্তি আসে না আবার অপূরণেও দুঃখ হয়। তাই বিষয় চিন্তায় রত না হইয়া আত্ম চিন্তায় বা ভগবান চিন্তায় মনোনিবেশ করা যথার্থ শান্তির উপায়।

(২) যে কোন কর্ম শ্রীভগবানের সেবা এইরূপ ধারণা রাখিয়া প্রত্যেক কর্মে পূর্ণ নিষ্ঠা রাখিয়া কর্ম করা :

শ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজ বলিতেন প্রত্যেকটি কর্ম করিবে খুব নিষ্ঠা সহকারে। কোন কাজে তাচ্ছিল্য করিতে নাই। প্রত্যেকটি কাজই শ্রীভগবানেরই কাজ। এইরূপ ধারণা মনের মধ্যে রাখিতে হয়। কোন কাজ ছোট, কোন কাজ বড় এইরূপ ভাবিতে নাই। ঝাড়ু দেওয়া, পায়খানা পরিষ্কার করা প্রভৃতি সব কাজেই সমান নিষ্ঠা রাখিতে হয়। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজও যিনি পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও যত্ন লইয়া করিতে পারেন, জপ ধ্যানেও তিনি উন্নতি করিবেন।

কর্মে শিথীলতা করিলে ভজনে মন একাগ্র হয় না। বাবা বলিতেন বাহিরে উদাসীন হইলে চলিবে না ভিতরে উদাসীন থাকিয়া বাহিরে দক্ষতার সহিত কাজ করিতে হইবে।

(৩) নিয়মে থাকা : মনকে বশ করিতে নিয়মানুবর্তিতার দ্বারা সুফল পাওয়া যায়। দিনের সমস্ত কাজ ঠিক নিয়মপূর্বক হওয়া উচিত। সকালে বিছানা ছাড়িয়া উঠিবার পর হইতে রাত্রে শুইতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সারাদিনের কার্যপ্রণালীকে এমনভাবে শৃঙ্খলিত করিয়া রাখা দরকার যাহাতে মন নিজের অভ্যাসেতে আপনা আপনি যে সময়ে যে কাজ সে সময়ে সে কাজে লাগিয়া যায়। জপধ্যানের জন্য প্রতিদিন যে জায়গায় যে সময়ে যে আসনটির উপর যে যোগাসনে বসিয়া সাধন করা হয় প্রতিদিন তাহা একইরকম হওয়া উচিত। ইহার ব্যতিক্রম করা উচিত নয়। পাঁচমিনিটের নিয়মিত ধ্যান অনিয়মিত অনেক সময়ের ধ্যানের চেয়েও ভাল। আজ দশমিনিট বসিলাম কাল আধঘণ্টা বসিলাম পরশ্ব একদমই বসিলাম না এইরূপে সাধনে সিদ্ধিলাভ কঠিন হয়। এইপ্রকার স্থান, আসন, সময়, ইষ্ট এবং মন্ত্রের বার বার পরিবর্তন করা উচিত নয়। আহার, পরিধান, শয়ন, ব্যবহার সবেতেই নিয়ম থাকা চাই। নিয়ম নিজের অবস্থা অনুসারে শাস্ত্র সন্মতভাবে বানিয়ে নেওয়া দরকার।




(৪) মনের কাজের ওপর বিচার করা:

মনের প্রত্যেক কাজের ওপর বিচার করিতে হয়। প্রতিদিন রাত্রে শোয়ার পূর্বে দিনের মনের সমস্ত কার্যের বিচার করা উচিত। যদিও দিনের সমস্ত চিন্তার কথা মনে থাকে না তবুও যে সমস্ত সঙ্কল্পকে সাত্ত্বিক মনে হয় তাহার জন্য মনকে প্রশংসা করা, সে সমস্ত সঙ্কল্পকে রাজসিক ও তামসিক বলিয়া মনে হয় তাহার জন্য মনকে ধিক্কার দিতে হয়। প্রতিদিন এই প্রকারে অভ্যাসের দ্বারা মনের ওপর সৎকার্য করা এবং অসৎ কার্য হইতে বিরত থাকার সংস্কার জমিতে থাকে। যাহার দ্বারা মন কিছুদিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে খারাপ কার্য হইতে সরিয়া আসিয়া ভাল কর্মে নিযুক্ত হয়। সেই সময় মনকে বশে আনা সুবিধা হয়। যেমন যে ছেলে কুসঙ্গে পড়িয়া গিয়াছে তাহাকে প্রথমে কুসঙ্গ ছাড়াইয়া আনিয়া পরে ধীরে ধীরে সদুপদেশ দিতে হয়। বিষয় চিন্তাকারী মনকে যদি হঠাৎ কেহ বিষয় চিন্তা হইতে সরাইয়া আনিতে চায় তাহা হইলে তাহাকে ব্যর্থ হইতে হয়। প্রথমে মনকে খারাপ চিন্তা হইতে রক্ষা করিতে হয়। পরে মন যখন ভগবানের শুভ চিন্তায় রত হয় তখন তাহাকে বশ করাও সুবিধা হইয়া যায়।

(৫) মনের কথা না শোনা:

যতক্ষণ পর্যন্ত মন বশীভূত হইতেছে ততক্ষণ পর্যন্ত মনকে নিজের শত্রু বলিয়া জানিতে হয়। যদিও মনরূপী শত্রু বড় ভয়ঙ্কর। ইহার কাছে আমাদের বার বার হারিতে হয় তবুও সাহস ছাড়িতে নাই। বাবা বলিতেন- পড়িবে তোমার জীবন অমৃতময় হইবে।' যে উদ্যম ত্যাগ না করে সে অবশ্যই একদিন না একদিন জয়লাভ করে। মনের সহিত এই যুদ্ধ এক বিচিত্র প্রকারের যুদ্ধ। যদি দৃঢ়তা সহকারে লড়াই করা যায় তাহা হইলে দিনে দিনে যিনি লড়াই করিতেছেন তাহার ক্ষমতা বাড়িতে থাকে। আর মনের ক্ষমতা কমিতে থাকে। তাই মনের হ্যাঁ তে হ্যাঁ না মিলাইয়া খুব বিচারপূর্বক চলিতে হয়। এই মন খুব চালাক, কখনও ভয় দেখায়, কখনও লোভ দেখায় কখনও নানাপ্রকার সুখের কল্পনা করিতে থাকে। কিন্তু কখনই ইহার ধোকাতে পরা উচিত নয়। ভুলিয়াও ইহাকে বিশ্বাস করিতে নাই। এইপ্রকার করিলে ধীরে ধীরে মনের ক্ষমতা নষ্ট হইয়া যায়। ইহার লড়াই করার অভ্যাস বহির্মুখী প্রবৃত্তি দূর হইয়া যায়। তখন মন অন্তর্মুখী হয়।

(৬) মনকে সৎকাজে লাগানো :

মন সাধারণত কখনও নিষ্কর্মা থাকিতে পারে না। কিছু না কিছু কাজ তার চাইই। তাই ইহাকে সবসময় কাজে লাগাইয়া রাখা উচিত। কোন কাজ না থাকিলে ইহা খারাপ চিন্তা করিতে থাকে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘুম আসিতেছে ততক্ষণ পর্যন্ত ইহাকে সৎচিন্তায় লাগাইয়া রাখা উচিত। জাগ্রত সময়ে সৎচিন্তার চিত্রই রাত্রে স্বপ্নতে দেখা যায়।

(৭) ধৈর্য ধরিয়া অভ্যাস করিতে হয় :

মনকে বশ করিবার চেষ্টা আরম্ভ করিবার পর প্রথম প্রথম মন এত জোর দেখায় যে নূতন সাধক ঘাবড়াইয়া যায়। তাহার হৃদয়ে নিরাশা আসে। ঐ সময়তে খুব ধৈর্য রাখিতে হয়। মনের স্বভাবই এই। ইহাতে ঘাবড়াইতে নাই লাগিয়া থাকিলে একদিন ফল দেয়। ধীরে ধীরে অভ্যাস বাড়াইতে হয়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়া লইতে হয় যে বৃথা চিন্তা বা মিথ্যা সঙ্কল্প যেন মনে একদমই না আসে। খুব চেষ্টা ও খুব দৃঢ়তা রাখার পরও সাধকের চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হইতে থাকে। সাধকভাবে আমি ধ্যান করিতেছি আর মনদেবতা সঙ্কল্প, বিকল্পের পূজায় লেগে থাকে। সাধক যখন মনের দিকে তাকায় তখন আশ্চর্য হয় একি হইল। এত চিন্তা কোথা থেকে আসে। 

আসল কথাটি হইল সাধক যখন ধ্যান করিতে চায় তখন নিত্য অভ্যস্ত সাংসারিক বিষয়সমূহকে চিন্তা করিবার ফুরসৎ মন পাইয়া যায় কারণ ভগবানের চিন্তায় মগ্ন থাকিবার অভ্যাস তখনও তাহার পুরা হয় নাই। তাই ফুরসৎ পাইলেই চিত্তের মধ্যে সংস্কার রূপে অঙ্কিত পুরানো দৃশ্যগুলিকে উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে থাকে এবং তাল মিলাইয়া ভবিষ্যৎ কল্পনা করিতে থাকে। জপধ্যানের সময় এত সঙ্কল্প মনে উঠিতে থাকে যে সংসারে কাজ করিবার সময় অত সঙ্কল্পের কথা মনে ওঠে না। মনের এইরূপ প্রবণতা দেখিয়া সাধক স্তম্ভিত হইয়া যায়। কিন্তু চিন্তা করিবার কিছু নাই, যখন অভ্যাসের বল বাড়িবে তখন ফুরসৎ পাইলেই মন পরমাত্মায় লাগিয়া যাইবে। অভ্যাস দৃঢ় হইলে পর মনকে পরমাত্মা হইতে সরাইয়া লইতে চাইলেও সে সরিবে না। মন সুখ চাইতেছে, সে বিষয়ের মধ্যে সেই সুখের সন্ধান করিতেছে কিন্তু সেখানে সে সেই সুখ পাইতেছে না কারণ সেখানে সেই সুখ নাই। অভ্যাসের দ্বারা যখন মন ধ্যানের জগতে পরমাত্ম সুখের অনুভব করে তখন সে তাহা হইতে আর সরিতে চাইবে না।




(৮) একতত্ত্বের অভ্যাস করা:

পাতঞ্জল যোগদর্শনে মহর্ষি পাতঞ্জলি বলিয়াছেন 'তৎ প্রতিষেহাইমেকত ত্ত্বা ভ্যা সঃ' চিত্তের বিক্ষেপ দূর করিবার জন্য শাস্ত্র নির্দিষ্ট এক তত্ত্বের অভ্যাস করা উচিত। একতত্ত্বের অভ্যাস বলিতে বোঝায় কোন একটি নির্দিষ্ট বস্তুর দিকে বা কোন একটি বিশেষ মূর্তির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। যতক্ষণ না চোখের পলক পরে বা চোখে জল না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত একটি চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকা। চিহ্নটি ধীরে ধীরে ছোট করিতে হয়। শেষে চিহ্নটিকে একেবারেই সরিয়ে নিতে হয়। দৃষ্টিঃ স্থিরা যত বিনাবলোকনম্কোন চিহ্ন না থাকিলেও দৃষ্টি স্থির থাকিবে। এইরূপ হইয়া যাইলে পরই চিত্তবিক্ষেপ থাকিবে না। এইরূপ প্রতিদিন আধ আধ ঘণ্টা অভ্যাস করিতে পারিলে মনকে স্থির করিতে খুব ভাল সফলতা পাওয়া যাইবে। এইপ্রকার দুইটি ভ্রু-র মাঝখানে যতক্ষণ পর্যন্ত না চোখে জল আসে ততক্ষণ পর্যন্ত দেখিতে থাকার অভ্যাস করিতে হয়। ইহাতেও মন নিশ্চল হয়। ইহাকে ত্রাটক বলে।

(৯) নাভি বা নাসিকাগ্রতে দৃষ্টি স্থাপন করা :

প্রতিদিন নিয়মপূর্বক পদ্মাসনে বা সুখাসনে সোজা হইয়া বসিয়া নাভির দিকে দৃষ্টি রাখিয়া যতক্ষণ পর্যন্ত না পলক পরে ততক্ষণ একমনে দেখিতে থাকা। এইরূপ করিলে শীঘ্রই মন স্থির হয়। এইপ্রকার নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি রাখিয়া বসিয়া থাকিলেও মন নিশ্চল হয়। এই সময় জ্যোতিরও দর্শন হয়।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad