No title

বহুবার আমার বহুতলের জানালা থেকে খুঁজেছি সেই মেঘের ভেলা। কাশফুল আর শিউলি। হাডসন নদীর পাশে বহুবার খোঁজ করেছি দুলতে থাকা কাশ ফুলের মনভোলানো সাদা রূপের ডালি। আমার ভাতৃসম সাংবাদিক ও ইংরাজী ভাষার একজন নভেলিষ্ট তারক ঘোষ বলেছিলেন,’ সংবাদ ভয়েস ৯’ এর জন্য কিছু একটা লিখতে প্রবাসের দুর্গাপুজো নিয়ে। তাই পুজোর স্মৃতি নিয়ে কমপিউটারের সামনে …
সুপ্রতীম ঘোষ, নিউ ইয়র্ক সিটিঃ এখানে এসেছি প্রায় ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে। যুবক বয়সে উচ্চ-শিক্ষার জন্য গ্রামের বাড়ি ছেড়ে পা বাড়িয়েছিলাম আটলান্টিক পার হয়ে আমেরিকার স্বপ্নরাজ্যে। প্রথমে কানাডা, তারপর পা রেখেছিলাম এই শহরে। অনেক স্মৃতি, কিন্তু একটা স্মৃতি আজও আমার মনে শরতের মাধুর্য্য বয়ে আনে। বহুবার আমার বহুতলের জানালা থেকে খুঁজেছি সেই মেঘের ভেলা। হাডসন নদীর পাশে বহুবার খোঁজ করেছি দুলতে থাকা কাশ ফুলের মনভোলানো সাদা রূপের ডালি। পরক্ষণেই মনে মনে হেসেছি। এটাতো আমার গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দামোদর নয়, যেখানে শরত আসে কাশফুলে, মায়ের মুখের ছবি নিয়ে ভেসে যায় মেঘের ভেলা। এটা কুইন্স। 


আমার জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। আমার ভাতৃসম সাংবাদিক ও ইংরাজী ভাষার একজন নভেলিষ্ট তারক ঘোষ বলেছিলেন, কিছু একটা লিখতে প্রবাসের দুর্গাপুজো নিয়ে। কী লিখবো ভাবতে ভাবতে আমার শহরের একটা পুজোর কথা মনে এলো। আমরা হিন্দু বাঙালিরা এখানে সবাই এক। গঙ্গা-পদ্মা মিলেমিশে একাকার। আর একটা কথা এখানে সবাই কর্মজীবী, তাই পুজোর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকলেও পুজোটা চলে উইক-এন্ড জুড়ে। এবারে পুজো শুরু হবে ৭-৮ অক্টোবর, তার মানে সপ্তাহান্তে।
১৯৬৮ সালে আমেরিকান অভিবাসন আইন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সংখ্যক বাঙালি পেশাদার এই শহরে আসতে শুরু করেছিল। এদের বেশিরভাগ ভারত থেকেই, আমার মতোই। বেশিরভাগটাই চাকরির সন্ধানে। করে। নিউ ইয়র্ক সিটি এলাকায় বাঙালি জনসংখ্যা প্রথমে ধীরে ধীরে এবং তারপরে বেশ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ১৯৭০ সালের মধ্যে যখন প্রথম দুর্গাপুজো উদযাপিত হয়, তখন বাঙালি জনসংখ্যা ১০০-২০০ এর মধ্যে ছিল । ১৯৭৫ সালে এই নিউইয়র্কেই কয়েক হাজার বাঙালি বাস করত। বাঙালিদের আরেকটি বিশাল ঢেউ আসে বাংলাদেশ থেকে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই শহরে দুর্গাপূজা উদযাপনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইস্ট কোস্ট দুর্গাপূজা এসোসিয়েশন’ নিউ ইয়র্কের দুর্গাপুজো প্রথম সংগঠক ছিল। এটি কুইন্সের বরোতে অবস্থিত। কুইন্স লং আইল্যান্ডে অবস্থিত, নিউ ইয়র্ক সিটির বৃহত্তম বরো। এদের লক্ষ্য আমেরিকায় বাঙালি ও ভারতীয় ঐতিহ্যকে উন্নীত করা। নিউ ইয়র্কের একটি ছোট অভিবাসী বাঙালি সম্প্রদায় প্রথম দুর্গাপূজা আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইস্ট কোস্ট দুর্গাপূজা এসোসিয়েশন নামে একটি নবগঠিত প্রতিষ্ঠানের অধীনে অত্যন্ত গর্ব ও উদ্দীপনার সাথে এটি উদযাপিত হয়। সেই সংগঠনের প্রথম সভাপতি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রয়াত অরুণ ঘোষাল।

প্রথমদিকে, এই পুজো শুধুমাত্র প্রায় ১০০-২০০ বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে সংখ্যাটা কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ভারতীয় ও বাংলাদেশী বাঙালিও রয়েছে। অষ্টমী অঞ্জলি থেকে কুমারী পুজো, সব আচার-অনুষ্ঠানই হয় খাঁটি বাঙালি কায়দায়। টানা তিন দিন ধরে উৎসবে সামিল হন সদস্য ও দর্শনার্থীরা। ভোগের আকারে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয় তিন দিনই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সন্ধ্যায় শিল্পীদের পরিবেশনায় জনতাকে বিনোদন দেওয়া হয়।
এখানে, পুজোর সময় মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক কিছুই মিস করি। পুজোর এক মাস আগে থাকতে খইভাজা, মোয়া, নাড়ু তৈরি, মা-কাকিমা, জেঠিমা – একান্নবর্তী সেই সংসার, গ্রামের পুজোয় সেই প্যান্ডেলে একটু একটু করে প্রতিমা তৈরি, নদীর ধারে কাশফুল আর বাড়ির উঠানে শিউলিফুল- সব মিস করি। এখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া শুনি আর মনে পড়ে বাবার কথা। অনেক কিছু হারিয়ে তবু এই প্রবাসে মেতে উঠি মায়ের আরাধনায়। তিনি তো সর্বত্র।

ছবি সৌজন্যঃ ইস্ট কোস্ট দুর্গা পূজা এসোসিয়েশন কুইন্স, নিউ ইয়র্ক


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad