রাজ্যের ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন এ বছরের শেষে, কি সামনের বছরের প্রথমের দিকে হবে, তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আজ রাজ্যের সামনে একের পর এক দুর্নীতির কাঁটার মুকুট। সমালোচনার ঝড় রাজ্য জুড়ে। বিরোধী দলগুলি এবার কিছু পাওয়ার আশায় আসর জমিয়েছে। প্রশ্ন, রাজ্যের প্রধান শাসক তৃণমূল কি পারবে তাদের মুকুট থেকে কাঁটা বেছে, নির্বাচনের ফলে তাদের ধারাবাহিক সাফল্য দেখাতে? বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে সংবাদ ভয়েস ৯ এর প্রতিনিধিরা হুগলি জেলার ধনিয়াখালি ও তারকেশ্বর ব্লকের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন জেলার ওই এলাকাগুলিতে শাসক ও বিরোধী দলের অবস্থা ও অবস্থান কি। আজ এই প্রাক-পঞ্চায়েত নির্বাচন সমীক্ষার প্রথম কিস্তি।
মৈনাক পালঃ কোন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দূর্নীতি নির্বাচনে দলকে কতটা বিপদে ফেলতে পারে, তার নিদর্শন অনেক আছে। কিন্তু, দেখা গেছে কী ধরণের নির্বাচন অর্থাৎ লোকসভা, বিধানসভা, পৌরসভা না ত্রিস্তরীয় গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচন – দূর্নীতির প্রভাব বিভিন্ন নির্বাচনে বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। নির্বাচনের আগে ভোটাররা অনেক কিছুই ভাবেন, একেবারে মাথায় দলের প্রতীক নিয়ে ছুটে গিয়ে বোতাম টিপে দিয়ে চলে আসেন, এমন ভাবার কারণ নেই। তবে, দূর্নীতি নিয়ে দু রকম ভাবনা কাজ করে ভোটারদের মধ্যে। প্রথমতঃ কোন রাজনৈতিক দল কি সরাসরি এই দূর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, না দলের কোন ব্যাক্তি নিজস্ব লোভের কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি দলকে বিব্রত করেছে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৃণমূলের সামনে বেশ কিছু দূর্নীতির অভিযোগ। যেমন এস এস সি দূর্নীতি, প্রাইমারীতে শিক্ষক ও অশিক্ষক নিয়োগ দূর্নীতি। শিক্ষা দপ্তরের দূর্নীতি ছাড়াও গরু ও কয়লা পাচার মামলাও ঝুলছে রাজ্যের শাসক দলের সামনে। গ্রেপ্তার হয়েছেন তৃণমূলের মন্ত্রী তথা হেভিওয়েট নেতা পার্থ চ্যাটার্জী, দলের আর এক হেভিওয়েট নেতা অনুব্রত মন্ডল। মিলেছে কোটি কোটি টাকার পাহাড়, সম্পত্তির হদিশ।
দলও যে এ নিয়ে বিব্রত তা মুখে স্বীকার না করলেও, বেশ কিছু কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রীমো মমতা ব্যানার্জী। দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলকে দূর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু কড়া ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রশাসনিকভাবে ১০০ দিনের কাজের ভূয়ো বিল নিয়ে নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনকে। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, এই দূর্নীতির অভিযোগ তারকেশ্বরের ভোটারদের কতটা প্রভাবিত করেছে। তারকেশ্বরে ২০১১ সালের আগে ছিল বামফ্রন্ট অর্থাৎ মূলতঃ সিপিএম এর রাজ। তাদের কথা মানেই শেষ কথা।
আমরা যদি হুগলি জেলার বিগত ত্রিস্তরীয় নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকাই, দেখবো -হুগলি জেলা পরিষদের মোট আসন ২০০৮ সালে ছিল ৪৭ টি । ২০০৮ সালে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৩৬ টি, তৃণমূল ১১ টি। ২০১৩ সালে তৃণমূল ৫০ টির মধ্যে ৪৬ টি, বামফ্রন্ট ৪ টি। ২০১৮ সালে তৃণমূল ৫০ টির মধ্যে ৫০ টি পায়, বাকিরা শূন্য। ১৮ টি পঞ্চায়েত সমিতি ও ২০২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন দখল করে তৃণমূল।
তারকেশ্বরে মোট গ্রাম পঞ্চায়েত ১০ টি। এগুলি হলো আস্তারাদত্তপুর, বালিগোড়ি ১, ২, ভঞ্জিপুর, চাঁপাডাঙ্গা, কেশবচক, নৈটামালপাহাড়পুর, পূর্ব রামনগর, সন্তোষপুর ও তাল্পুর।
আমরা বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলাম সাধারণ মানুষের কাছে, যারা সরাসরি বিজেপি, তৃণমূল বা বামফ্রন্ট, কংগ্রেসের অনুগামী নয়। আমাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে এই সমস্ত সাধারণ ভোটাররা যা জানিয়েছিলেন, তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তৃণমূলের উন্নয়নের রাজনীতি জনগনকে এমনভাবে প্রভাবিত বা উপকৃত করেছে যে দূর্নীতির পাল্লা সেভাবে ছাপ ফেলতে পারেনি। যদিও বিরোধীদের কথা, তৃণমূল টাকা ছড়িয়ে রাজ্যের অর্থনীতির ক্ষতি করছে, কিছু মানুষকে পাইয়ে দিয়ে ভোটবাক্স মজবুত করছে।
আমাদের প্রশ্নের উত্তরে অনেকে বলেছেন, দেখুন কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, মাসিক ৫০০ টাকা, সাইকেল, মোবাইল, স্বাস্থসাথী, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড – এগুলোতে আমরা উপকৃত।
আমাদের পালটা প্রশ্ন ছিল, এভাবে কী জীবনের মান উন্নয়ন করা যায়? যদি সরকার বদলে যায়, এ সব তো বন্ধ হয়ে যাবে? তারা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, সেই জন্যই তো, সরকারকে রাখা দরকার।
আমাদের প্রশ্ন ছিল, তার মানে সরকারের কাছ থেকে পাওয়ার আশায় ভোট দেন?
তাদের উত্তর ছিল, দেখুন, এর আগেও দেখেছি, এলাকায় কতটা উন্নয়ন হয়েছে, উন্নতি হয়েছিল তারকেশ্বরের কিছু পার্টির নেতার। সবাই জানে বামফ্রন্টের সময় এখানে কী হয়েছে।
আমাদের প্রশ্ন, এখনো তো গ্রাম-পঞ্চায়েত স্তরে বেশ কিছু স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে।
তার উত্তরে তারা বলেন, সেটা যে উঠছে না, তা নয়। তবে এটা ঠিক, ওই মানুষগুলোকে আমরা চিনি, ওরা ব্যাক্তিগত ভাবেই খারাপ। একসময় অনেকেই অন্য পার্টি করতো, সূযোগ বুঝে তৃণমূলে ঢুকেছে।
আপনারা কী মনে করেন, আপনাদের গ্রামে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে দূর্নীতির অভিযোগগুলো উঠছে, তার প্রভাব পড়বে না?
প্রভাব একটা পড়ে। যারা পাচ্ছে আর যারা পাচ্ছে না , তাদের মধ্যে একটা লড়াই আছে। কিছু মানুষ তো ভাববেই, কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করে এই সমস্ত মানুষগুলোর বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেবে। আর যদি, সেটা হয়, এলাকায় ঠিকঠাক লোক টিকিট পায়, তাহলে এই দূর্নীতির অভিযোগ ভোটবাক্সে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। আমরা এলাকার মানুষ, ভালো-খারাপ চিনি, কিন্তু রাজনীতি করিনা। বুথে ভালো মানুষকেই ভোট দেব। দলের দায়িত্ব আমাদের এমন নেতা-সদস্য দিন যারা কাজটা ঠিকঠাক করবে।
আর বিজেপি?
ছিল। কিন্তু, এখন গ্রামস্তরে জনগণের সঙ্গে সেভাবে দেখা যায় না। এলাকায় ওদের সংগঠন মজবুত নয়
চলবে...