ভয়েস ৯, পুজো পরিক্রমাঃ সময় আনেক কিছুই মুছে দিয়ে যায়, আবার অনেক কিছু উজ্জ্বল হয়ে থাকে সময়ে অনন্ত পথে। দুর্গাপুজোর ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, বহু প্রাচীন পুজো আজ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার বহু পারিবারিক পুজো আজও বনেদি তকমা নিয়ে প্রাচীন সময়ের সাক্ষ্য আর প্রথা মেনে আজও নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হচ্ছে। আমরা সেই পুজোগুলিকেই তুলে আনছি, যে সমস্ত পুজোর উদ্যোক্তারা আজও এই দুর্মূল্যের বাজারে হারিয়ে যেতে দেননি তাদের পুরানো ঐতিহ্যকে।
বর্ধমানের খান্দরার সরকার পরিবারের পুজো এ বছর আনুমানিক ৫০২ বছরে পা দিল। প্রচলিত লোককথায় জানা যায়, এই সরকারদের আদি বাসস্থান ছিল মুর্শিদাবাদের কান্দি অঞ্চলে এবং সেখানেই দুর্গাপুজো প্রথম শুরু হয়েছিল। বর্তমানে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিম বর্ধমানের খান্দরায়। তবে কান্দি অঞ্চলে থাকাকালীন সরকার পরিবারের উপাধি ছিল ‘দাস’। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে পর্বত দাস মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে আসেন খান্দরায় রাজস্ব ভাগ দেখাশোনা করার জন্য। সে সময় তিনি বর্ধমানের মহারাজার থেকে ‘সরকার’ উপাধি লাভ করেছিলেন।
কিছু কাল পরে সরকার পরিবারের দুই সদস্য, পাহাড় সরকার ও পর্বত সরকারের মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ায় পরিবার দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। খান্দরায় আসার পর বংশের সুসন্তান মুচিরাম সরকার এই বাড়ির ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। সেই পুজোই আজও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছেন বর্তমান সদস্যরা।
এই বাড়ির পুজো শুরু হয় রথযাত্রার দিন কাঠামোপুজোর মাধ্যমে। মৃন্ময়ী প্রতিমাতে দু’ মাটির প্রলেপ দেওয়ার পর খড়ি দিয়ে রঙ দেওয়া হয়। দেবীর দশ হাতের অস্ত্র রাংতা দিয়ে তৈরি করা হয়। সাবেকি একচালার প্রতিমায় নানা রকমের প্রাচীন গয়না দিয়ে সাজানো হয় উমাকে। এই পরিবারে প্রতিমার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল দেবীর ডান দিকে থাকেন লক্ষ্মী ও কার্তিক এবং বাঁ দিকে থাকেন সরস্বতী ও গণেশ।
দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্নান করানো হয় নিকটবর্তী দুর্গাপুকুরে। স্নানপর্ব শেষ হলে ঠাকুরদালানে এসে পরিবারের মহিলারা তাঁকে বরণ করেন এবং তার পর শুরু হয় দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা ও মূলপূজা। বর্তমানে সরকার পরিবারের পাঁচ উত্তরসুরির জন্য পাঁচটি ঘট বসানো হয় এবং লোককথায় জানা যায় যে একসময়ে এই বাড়িতে অঞ্জলি দিতে এসেছিলেন তৎকালীন পুলিশমন্ত্রী কালীপদ মুখোপাধ্যায়।
খান্দরার সরকারবাড়িতে দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিন বিশেষ ভোগের আয়োজন করা হয়। ভোগে থাকে লুচি, নানান রকমের ভাজা, নাড়ু, মিষ্টি ইত্যাদি। পশু বলিদানের প্রথা এই পরিবারে বহু দিন আগে প্রচলিত ছিল। তবে বর্তমানে আখ ও চিনি বলিদান হয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী মহারাজা সুরথের পূজিত প্রথম মৃন্ময়ী দুর্গাপুজোর স্থান গড়জঙ্গল থেকে আসা শব্দধ্বনি শুনেই বলিদান শুরু হয় এই বনেদিবাড়িতে। মহাষ্টমী পুজোর শেষে দেবীর প্রসাদ সকল ভক্তের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
দুর্গাপুজোর মহানবমীর দিন এই বাড়িতে হোম হয় এবং বাড়ির প্রতিটি সদস্য হোমের তিলক নিয়ে তার পর দেবীকে দর্শন করেন। সন্ধ্যাবেলায় পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে ধুনুচিনাচে যোগ দেন।
দশমীতে সকালে দেবীর দর্পণে বিসর্জন হয়। এর পর মাছপোড়া খেয়ে নিয়ম ভঙ্গ করেন পরিবারের সদস্যরা।
সন্ধ্যায় দেবীবরণের পর মহিলারা সবাই মিলে ঠাকুরদালানে সিঁদুর খেলেন। কনকাঞ্জলিপ্রথার পর দেবীকে বিসর্জনের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ভাবে ঐতিহ্যের সঙ্গে আজও পরম্পরাকে অক্ষুণ্ন রেখে পুজো করে আসছেন পশ্চিম বর্ধমানের খান্দরা গ্রামের সরকার পরিবারের সদস্যরা।