দেবী দুর্গা এখানে দ্বি-ভূজা, পাশে শিবঃ চুঁচুড়ার বড়ো শীলবাড়ির দুর্গা

রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো। রয়েছে অনেক ইতিহাস। অনেক অজানা কথা। দুর্গা-প্রতিমাও নানা রূপে বিরাজমানা। ইতিহাস হয়ে যাওয়া এই পুজো তার স্বমহিমায় আজও তার স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। মায়ের আরাধনায় এই সমস্ত বংশের আদি পুরুষরা যে ধারার প্রচলন করে গিয়েছিলেন, আজ কয়েকশো বছর পার হয়েও তা অম্লান। বংশের নানা শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশ জুড়ে, তবু পুজোর সময় তারা যেখানেই থাকুন, ফিরে আসেন জন্মভূমিতে মাতৃ-আরাধনায়। আমাদের বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজায় আজ চুঁচুড়ার বড়ো শীলবাড়ির দুর্গা দ্বিভূজা।
শম শতক। বঙ্গে তখন মহারাজা আদিশূরের রাজত্ব চলছে। ষোলোটি বণিক পরিবারের অনুগত ৩০ জন বণিক অযোধ্যা থেকে অবিভক্ত বঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) বিক্রমপুর হয়ে বর্ধমানের উজানিনগরে এসেছিলেন। সেই বণিক পরিবারের মধ্যে শীল বংশের পূর্বপুরুষও ছিলেন। গোবর্ধন মিশ্রের কুলপুস্তক থেকে জানা যায়, এই শীল বংশের আদিপুরুষ ছিলেন মেঘু শীল। মেঘু শীলের অধস্তন চতুর্দশ পুরুষ প্রয়াগ শীল তাঁদের পারিবারিক কুলদেবতা শ্রীধর জিউকে নিয়ে বর্ধমানের পাঁচড়া গ্রামে চলে আসেন। প্রয়াগ শীলের অধস্তন অষ্টম পুরুষ চৈতন্য শীলের ভাই যাদব শীল পাঁচড়া গ্রাম থেকে ব্যাবসার জন্য সপ্তগ্রামে এসে বসবাস করেন। 


শীল বংশের সুসন্তান যাদব শীল সম্ভবত সুলতানি শাসকদের সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্ত ছিলেন এবং লাভ করেছিলেন ‘মল্লিক’ উপাধি। কিন্তু পারিবারিক বিবাদের কারণে পরিবার ভাগ হয়ে যায়। যাদব শীলের বংশধরেরা সপ্তগ্রামেই থেকে যান এবং চৈতন্য শীলের পরিবার বর্ধমানের পাঁচড়া গ্রামেই বসবাস করতে থাকেন। এর কিছুকাল পরে অর্থাৎ ১৭৪১ সাল থেকে বাংলা জুড়ে শুরু হয় বর্গীদের তাণ্ডব। সেই আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য শীল পরিবারের সদস্যরা সে বছরই বর্ধমান ত্যাগ করে ব্যান্ডেলের কাছে শাহগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। শীল পরিবারের সদস্যরা ১৭৫৭ সাল অবধি সেখানেই বসবাস করেন। 


শুধুমাত্র বর্গীদের আক্রমণই নয়, শুরু হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নবাব সিরাজের বিবাদ-পর্ব, যেখানে ব্রিটিশ জেনারেল রবার্ট ক্লাইভের সেনাদল চন্দননগর, হুগলি, ব্যান্ডেল অঞ্চলে লুটপাট চালায়। তার ফলে শাহগঞ্জ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় নীলাম্বর শীল, যিনি পাঁচড়া গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, চলে আসেন চুঁচুড়ার কনকশালিতে ১৭৫৮ সালে। কনকশালিতে বসবাস করার পর ১৭৬৩ সালে বর্তমান বড়ো শীল বাড়ি স্থাপিত হয়। নীলাম্বর শীলের তৈরি করা বাড়িটিতে ইন্দো-ডাচ স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব দেখা যায় এবং বাড়ির কেন্দ্রস্থলে রয়েছে এক অপূর্ব ঠাকুরদালান যা তৈরি করেছিলেন নীলাম্বর শীলের পুত্র মদনমোহন শীল ১৮০৩ সালে। এই ঠাকুরদালানেই রমরমা করে পুজো হয়ে আসছে দেবী দুর্গার। শীলবাড়ির সদস্যদের কাছে জানতে পারা গেল যে অতীতেও দুর্গাপুজো হত তবে তা ছিল ঘটপুজো। পরবর্তী কালে সেই ঘটপূজোই মূর্তিপূজায় রূপান্তরিত হয় চুঁচুড়ার বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। উলটোরথের দিন কাঠামোপুজোর মাধ্যমে শুরু হয় শীলবাড়ির মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরি করার কাজ। বলা বাহুল্য, হুগলির বণিক পরিবারগুলি চৈতন্যদেবের আমল থেকেই বৈষ্ণবধারায় বিশ্বাসী। তাই শীলবাড়ির পুজোও সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে হয়, বলিদানের প্রথাই নেই এই বাড়িতে। 



এই বাড়ির দেবী কিন্তু দশভূজা নন, তিনি শিবনন্দিনী অর্থাৎ শিবের ক্রোড়ে বসে আছেন তিনি। তাঁর দুই হাত, এক হাতে তিনি বরদাত্রী এবং অন্য হাতে তিনি অভয়দায়িনী। 

একচালার প্রতিমায় সপরিবার হরগৌরী বসে থাকেন শীলবাড়ির ঠাকুরদালানে। প্রতিমা ডাকের সাজের হয় এবং চালচিত্রে দুর্গার বিভিন্ন রূপ অঙ্কিত থাকে। ষষ্ঠীতিথিতে বোধন হয় মায়ের, সপ্তমীর দিন কলাবউকে স্নান করানো হয় এবং তার পর দেবীর চক্ষুদান ও মূলপূজা শুরু হয়। এই বাড়িতে চালের নৈবেদ্য, চিনির নৈবেদ্যর সঙ্গে থাকে নানা রকমের মিষ্টান্ন, ফল ইত্যাদি। আগে ভিয়েন বসিয়ে হরেক রকম মিষ্টি তৈরি করা হত। এখনও বাড়িতে মিষ্টি তৈরি হয় তবে পরিমাণে কম। এই বাড়িতে পুজোর সময় ধুনো পোড়ানোর রীতি রয়েছে এবং মহাষষ্ঠীর দিন সন্ধিপূজায় ১০৮টি পদ্ম নিবেদন করে ১০৮টি দীপ জ্বালানো হয়। দশমীর দিন সকালে চিঁড়েভোগ হয় এবং সন্ধ্যায় দেবীবরণের পর সিঁদুরখেলা ও তার পর বিসর্জনের পথে রওনা। বিসর্জন থেকে ফিরে এসে পরিবারের সদস্যা সকলে মিলে ঠাকুরদালানে শান্তির জল নেন এবং কুলদেবতার ঘরে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করেন। চুঁচুড়ায় বড়ো শীলবাড়ির ঠাকুরদালানে গেলে অনুভূত হয় এই পরিবারের পুজো কেন এত বিখ্যাত এবং এই পরিবারের ঐতিহ্য কতটা প্রাচীন।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad