ধর্মক্ষেত্রঃ শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াবাবাজী; 'যেমন দেখেছি তাঁরে' ৩



শ্রীবাবাজী মহারাজ ছিলেন সমাজ-সংষ্কারক,  তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘মার্কস ও নিম্বার্কের চিন্তাধারায় এই সমাজ’

তারক ঘোষ

 

 শ্রীবাবাজী মহারাজ হলেন এমন আধুনিক এক সন্ন্যাসী, যিনি অনায়াস দক্ষতায় মেলাতে পেরেছেন প্রাচীন সংষ্কার আর বিজ্ঞানমনস্কতাকে। তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু আর শ্রীমদ্ভগবতগীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, তার কাছে জ্ঞানী নয়, জ্ঞানপিপাসুরাই অধিক কাম্য। শ্রীবাবাজী মহারাজের মধ্যে মূর্ত হয়েছিল শ্রীগীতার তিন ‘যোগ’ – জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ আর ভক্তিযোগ। আমাদের বাবাজী ছিলেন এমন এক মহামানব, যার কর্ম, ভাবনা বিশ্লেষণ করা খুবই কঠিন। তিনি একাধারে কঠিন, অন্যধারে এক নরম মনের অধিকারী। মানুষের শুধু অন্তর নয়, বাহির সংষ্কারের কথাও তিনি ভেবেছিলেন। বহু মানুষ, পরিবার তার ভালোবাসার দান এ উপকৃত হয়েছেন। বাইরে স্বীকার করুন বা না করুন, তারা নিজেরাই জানেন, তারা শ্রীবাবাজী মহারাজের দ্বারা কতটা ও কীভাবে উপকৃত হয়েছেন।  শ্রীবাবাজীকে জানতে হলে প্রথমেই তার গবেষণাপত্রটি পাঠ করা প্রয়োজন। সকলেই জানেন, তিনি ১৯৯১ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার গবেষণাপত্রের স্বীকৃতি হিসাবে ডক্টরেট লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘মার্কস ও নিম্বার্কের চিন্তাধারায় এই সমাজ’। আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত লাগতে পারে গবেষণার বিষয়। কারণ কার্ল মার্কসের তত্ব ও নিম্বার্কবাদের অবস্থান ভিন্ন মেরুতে। তাহলে সেটা মিলবে কীভাবে? শ্রীবাবাজী তার গবেষণাপত্রে লিখছেন, প্রতিটি সামাজিক চিন্তাবিদ যে মূল সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করেন তা হল মানুষ এবং এটি একটি বিমূর্ত মানুষ নয়, বরং বাস্তব এক মানুষ, ব্যক্তি। মার্কস এবং নিম্বার্ক উভয়েই মানুষের ব্যক্তি সম্পর্কে চিন্তা করেন এবং ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন, তাকে পৃথিবীর শক্ত মাটিতে রাখেন। 


বার ফিরে আসা যাক, পরের ঘটনায়। সেই রাতটা ছিল আত্মবিশ্লেষণের রাত। বার বার তাঁর ছবিটা দেখছিলাম। দেখেছিলাম তার চোখের মধ্যে জ্ঞানের গভীরতা আর চরম প্রশান্তি। যে প্রশান্তির সন্ধানে সংসারী মানুষজন আশ্রমে ছুটে যান, কিন্তু ভুলে যান, তারা আশ্রমে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু মনের মধ্যে সংসারটাকেই বয়ে এনেছেন আশ্রমে। আশ্রমে এসে শ্রীগুরুদেবের কাছেই তার সাংসারিক দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরেন। যে অশান্তি সংসার নিয়েই, সেই অশান্তি তো থাকবেই, কিন্তু হাজারো সমস্যার মধ্যে থেকেও কীভাবে মনের শান্তি ধরে রাখা যায়, শ্রীবাবাজী তার উপায়ও বলে গেছেন। সে কথায় পরে আসব।


 শ্রীবাবাজী অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু, সত্যি বলতে কী, তিনি ছিলেন এক অলৌকিক পুরুষ। আমার সৌভাগ্য তিনবার আমার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আজো ভাবি, সত্যই কি? না কি সবটাই ভ্রম? সে রাতে আমি আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোথায় গেলে ওনার দেখা পাওয়া যাবে? তিনি বলেছিলেন, কাল উনি থাকবেন রবিকাকার বাড়ি, ওখানে যেতে পারো। আমি বলেছিলাম, না, আমি ওনার আশ্রমেই যাব।
 আমার স্ত্রীর কাছ থেকে জানতে চাইনি, তার সাংসারিক জীবনের পূর্কবথা, জানতে চাইনি তার পূর্ব-পরিচয়। শুধু জেনেছিলাম, উনি শ্রীশ্রীজানকীদাস কাঠিয়াবাবার শিষ্য। একসময় মেমারীর কাছে বরোড় আশ্রমে থাকতেন। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, এই বরোড় আশ্রমেই দীর্ঘ সময় কাটিয়ে গেছেন, জ্ঞানের আর এক দিকপাল মহামানব স্বামী জানকীদাসজী। তিনি এমন এক মহামানব ছিলেন, যিনি মহন্ত পদকেও অনায়াসে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারতেন। অথচ, এখন এই মহন্ত পদের জন্য কত লড়াই!
 প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই বরোড় আশ্রমের বর্তমান মহন্ত হলেন স্বামী লাডলীদাসজী। ওনার সঙ্গে আমার সরাসরি দেখা হয়নি, কিন্তু আজ থেকে বহু বছর আগেই শ্রীবাবাজীর তপোবন আশ্রমে দেখেছিলাম আরতি করতে। যাই হোক, সেদিন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম স্বামী ড. প্রজ্ঞাদাসজীর সঙ্গে দেখা করার কথা। কেন দেখা করতে চেয়েছিলাম? কেন? ‘কেন’ এর উত্তর খোঁজার জন্যই। 
আমি এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন সাংবাদিক হিসাবে আমার চোখের সামনে দূর্নীতির কথাই ঘুরে ফিরে আসে। দূর্নীতিবাজ কিছু ‘সাধু’ নামধারী ব্যাক্তিদের জন্য যে সমগ্র সাধু সমাজের প্রতি  একটা খারাপ ধারণা তৈরি হয়, তারা তো সেটা ভাবেন না। 


আমি শ্রীবাবাজীর কাছে যেতে চেয়েছিলাম, বেশ কয়েকটা প্রশ্নের উত্তরের জন্য। যেমন, শিক্ষা মানুষকে ঠিক কোন পথ দেখায়, আর সন্ন্যাসীরা যে পথের কথা বলেন, বা ঈশ্বর দর্শনের বা ঈশ্বর লাভের কথা বলেন, সেটা কি আদৌ সম্ভব? ঈশ্বর বলতে কোন নির্দিষ্ট ভগবানকে বোঝায়? না কি, কোন এক সর্বশক্তিমান একেশ্বর? তারা যে মুক্তির কথা বলেন, কী সেই মুক্তির রূপ? মুক্তি কি ‘ছাড়ার’ মধ্যে, না কি বন্ধন’এর মধ্যে। অনেক হাবিজাবি প্রশ্ন। জানিনা, তিনি কীভাবে নেবেন? উনি একজন জ্ঞানীপুরুষ, তাই জানার ইচ্ছা নিরসনের কথাই প্রথম এসেছিল মনে।
 অথচ, মজার কথা কী জানেন, যখন সত্যি সত্যি এক চৈত্রের দুপুরে হাজির হয়েছিলেম, তার আশ্রমে, কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। শুধু দেখে গিয়েছিলাম ওনার জনসংযোগ। সেখানে উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই। উনি আমাদের বসতে বলেছিলেন, পুরানো মন্দিরের দাওয়ায়। একপাশে শ্রীরাধাকৃষ্ণের মন্দির, অন্যধারে ওনার বসার আসন। সামনে, পাশে ভিড় করে আছেন গ্রামের বা বাইরে থেকে আসা মানুষজন। 


উনি রাধামাধব নামে এক তরুণকে ডেকে বলেছিলেন, "তারককে আমার বইগুলো দে। ও সাংবাদিক।"
 মা সরস্বতীর বরপুত্র তিনি, অর্থের সঙ্গে নয় বিদ্যার সঙ্গে তার যোগ। রাধামাধব নামে জটাধারী এক তরুণের আবির্ভাব হয়েছিল আমাদের সামনে। হাতে বেশ কয়েকটা বই। যার মধ্যে ছিল ওনার থিসিস সংক্রান্ত গ্রন্থটিও। সেদিন প্রথম রাধামাধবকে দেখি, আর সন্ধ্যায় দেখি তরুণবাবু আর সুকান্ত বাগচিকে। আগেই বলেছি, পরবর্তিকালে এই 'সুকান্ত বাগচি' সন্ন্যাস গ্রহণ করে বৃন্দাবন চলে যান। ওনার বর্তমান পরিচয় শ্রীসদগুরু দাসজী।
 কিন্তু এই ঘটনার আগে আর একটি ঘটনা আছে। সেদিন অর্থাৎ ২০০৩ সালের ১২ চৈত্র, আমরা আশ্রমে পৌছাতে পারতাম না, যদিনা শ্রীবাবাজী মহারাজের ইচ্ছা থাকতো।
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad