No title

যে মানুষের জীবনে জিজ্ঞাসা নেই, সেই জীবন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর এই জিজ্ঞাসা আসে –সন্দেহ আর প্রয়োজন থেকে… শান্তির অভাব থেকেই গীতার আবির্ভাব। তাই গীতার প্রথম অধ্যায়ের নাম বিষাদযোগ।“

শান্তির অভাব থেকেই গীতার আবির্ভাব, তাই বাবাজী মহারাজ চেয়েছিলেন –প্রতিটি মানুষের জীবনে ও কর্মে গীতার বাণী প্রতিফলিত হোক

তারক ঘোষ

 পর্ব ৩৭ 

 গীতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাবাজী বারবার বলতেন – মনটাই সব। এই মনটাই কুরুক্ষেত্র। মনের মধ্যে এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আজও শেষ হয়নি। কারণ, এখনও মনের মধ্যে খারাপ ও ভালোর যুদ্ধ চলছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ধর্মের জয় হয়, এই জয় অসৎ প্রকৃতির বিরুদ্ধে সৎ প্রকৃতির। 
তাই মানুষের উচিত, মনের মধ্যে থাকা অসৎ প্রকৃতিকে জয় করা। নাহলে শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে না। যুদ্ধ শুধু বাইরে নয়, ভিতরেও। বাবাজী তাই প্রায়ই বলেছেন – মনকে জয় করতে পারলেই সব জয় করা হয়ে গেল।
আজ চারিদিকে এক শূন্যতা। আশ্রমে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয়, কেউ নেই, কিছু নেই। সেই মন্দির আছে। আছে কাছাড়ী বাড়ি। আছে আমবাগান – অথচ কী যেন নেই। আজ আর আশ্রম চত্বর থেকে ভেসে আসে না বাবার সেই ললিতবাণী। আজ আর কেউ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সকাল সকাল গীতার পাঠ নেন না। আজ আর দলে দলে মানুষ এসে পায় না সেই শান্তির খোঁজ, যা একমাত্র বাবাজী মহারাজ দিতে পারতেন। 
একজন সুশিক্ষিত দার্শনিক ও সন্ন্যাসী্র প্রয়োজন সবাই অনুভব করছেন। তার এই অভাব, অন্য কেউ পূরণ করতে পারে না, সম্ভবও নয়। এটা ঠিক,জগতের নিয়মে বদল আসবেই। এটা সত্য। এই সত্যকে মেনে নিয়েও বলি, আমাদের বাবাজী মহারাজ যে স্তরে ছিলেন, সেই স্তরে এমন কাউকে পেলাম না, যিনি তার মতো করে জীবন, ধর্ম ও কর্মকে দেখতে পেরেছেন। 
আজ যখন চারিদিকে তাকাই, দেখি, সবাই টাকার পিছনে দৌড়াচ্ছেন। একশ্রেণির ভোগবাদী তথাকথিত ‘সাধু’ ব্যক্তিরাও পার্থিব সুখের সাধনায় মত্ত। দামী পোশাক, দামী গাড়ি, বিমানে যাত্রা, ধনী শিষ্য – আসলটাই যে কখন ফাঁকা হয়ে গেছে সেটাও তারা টের পান না। দেখেছি, জিজ্ঞাসু মানুষের জটিল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার যোগ্যতাও এদের নেই। এরকম অভিযোগও পাওয়া যায়।
বাবাজী মহারাজ, এই সমস্ত ভন্ড ‘সাধু’দের থেকে বারবার দূরে থাকার উপদেশ দিতেন। আমি জানি না কেউ সেটা মানেন কিনা, আমি মানি। আমি মনে করি, এরা না কাঁচা, না পাকা – দরকচা মেরে গেছে। আমি অবশ্যই ভন্ডদের কথা বলছি। কোন প্রকৃত সাধুদের কথা বলছি না। এরা ভারতের সম্পদ। তাই আমি ভন্ড সাধুদের কথা বলতে সাধু শব্দটিকে 'সাধু' হিসাবে লিখছি।
 বাবাজী তার গীতা চিরন্তনে (টীকা গ্রন্থের ) প্রথমেই বলেছেন – কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নিজের ভোগ-আকাঙ্খার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধ যে করে না সে ক্লীব, নপুংসক, সে মানুষ নয়। ঠিক তেমনই, যারা ভন্ডকে ভন্ড বলতে পারে না, অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারে না, প্রতিবাদ করতে পারে না, তারাও নপুংসক। ভোগের আকাঙ্খা চিরন্তন। রেহাই নেই। 
গৃহীরা ভোগ করবেন, এটা অস্বাভাবিক নয়, তাদের লোভ থাকবে- এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু, আমরা যখন দেখি একশ্রেণির মানুষ ‘সাধু’ হয়েও গৃহীদের মতোই ভোগাকাঙ্খায় লিপ্ত, তখন প্রশ্ন জাগতেই পারে। মনে হতেই পারে, এরা আমাদের কোন পথের সন্ধান দেবেন, বা দেওয়ার সেই যোগ্যতা তাদের আছে কি না। সবাই শ্রীরামকৃষ্ণ হন না, স্বামীজি হন না – কারণ তারা আবির্ভূত হন এই ধরায়, মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেবেন বলে। আমরা বোকা – তাই কাঞ্চন ছেড়ে কাঁচকেই বেছে নিই।
আমাদের বাবাও এই ধরা ধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন, মানুষকে গীতার বাণী দিয়ে পাপমুক্ত করতে। তার সেই কাজ অর্ধসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে। বাকি কাজের দায়িত্ব নেবার মতো কাউকে দেখি না। মার্জনা করবেন পাঠকরা, এটা আমার উপলব্ধি, আপনারাও যদি অন্ধত্ব ত্যাগ করে বুদ্ধি-জ্ঞান প্রয়োগ করে বিচার করেন, উত্তর পেয়ে যাবেন। 
বাবা তাই বলতেন, প্রশ্ন করতে হয়, নইলে জীবন কূয়োর মধ্যেই আটকে থাকে। আমার এই কথা ব্যক্তির প্রতি নয়, সিস্টেমের প্রতি। আসলে, যখন দেখি, কিছু মঠের 'সাধুরা' ধর্ষণের দায়ে জেলে যাচ্ছেন, অর্থের লোভে খুন করছেন বা করাচ্ছেন অন্য সাধুদের। টাকার পাহাড় তৈরী করছেন – মহিলাদের ভুল শিক্ষা দিয়ে নিজেদের ভোগের পথ পরিষ্কার করছেন, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে। 
বাবা বলতেন, দীক্ষা নেবার আগে যাচাই করে নে, সে আসল সাধু কিনা। দুঃখের কথা আমাদের মধ্যেও এমন মানুষ আছেন, তারা আদালতের রায়ে অপরাধী ধর্ষণকারী সেই ‘সাধু’র মধ্যেও দোষ দেখেন না। হাসবো? বাবাজী বলেছেন – অন্যায়ভাবে দোষ না দেখতে। কিন্তু নারী ধর্ষণ একটা দণ্ডনীয় অপরাধ। সামাজিক অপরাধ, বিশ্বাসের প্রতি অপরাধ। 
মাফ করবেন পাঠকরা, আমি এই ভন্ড নারীধর্ষণকারী কামুক ‘সাধু’দের সাধু ভাবতে শিখি নি। বাবাজী আমাকে সেই শিক্ষা দেন নি। যিনি বাইরে 'সাধুর' বেশ পড়ে ঘুরছেন আর মনে মনে ফিকির খুঁজছেন, কীভাবে কামনা নিবারণ করা যায়, তিনি শুধু অসাধুই নন, মানুষ নামেরও অযোগ্য। 
আমি এত কথা বললাম এই জন্য, যে এই ধরণের খবর আমরা সংবাদপত্রে প্রায়ই পাই। আর ভারতের আইন সকলের প্রতি প্রযোজ্য, তিনি যেই হোন না কেন। 
আসলে, অনেকেই ভাবেন, ভগবান দেখতে পাচ্ছে না। গোপনে যদি কিছু করি, কে দেখতে আসছে। তারা জানেন না, যে মুহুর্তে তারা এই পৃথিবীতে এসেছেন, তখন থেকেই ভগবানের ‘সিসিটিভি’ র অসংখ্য ক্যামেরা তার প্রতিটি পদক্ষেপ রেকর্ড করে রাখছে। এমনকি রাতের বেলাতেও, যেমন সিসিটিভি দ্যাখে।
  

দ্রৌপদীকে ভরা সভাক্ষেত্রে যেভাবে অসম্মান ও নির্যাতন করা হয়েছিল, তাকে আপনারা নিশ্চয় সমর্থন করেন না। যদিও, সেই মুহুর্তে বীর্যবান, বলবানরা মাথা নীচু করে বসে ছিলেন। এসেছিলেন একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ। তিনি রক্ষা করেছিলেন নারীর সম্মান। 
 আর আজ, নারীরা অত্যাচারিতা, ধর্ষিতা, নির্যাতিতা। কিন্তু, মানুষের মধ্যে সেই তেজ নেই, যা নিয়ে তারা রুখে দাড়াতে পারে। আজ আমাদের মধ্যে অনাচার ছেয়ে গেছে। কারণ কী? সেই মনের কুরুক্ষেত্র, যেখানে বারে বারে জয়ী হচ্ছে কুরুপক্ষ। তাই বাবাজী বলতেন, মানুষের মনের পরিবর্তন করতে পারলেই লোভ জয় সম্ভব, কামনা জয় সম্ভব। আর এই ভাবেই সমাজ আবার দূষণ্মুক্ত হয়ে উঠবে। তাই তার সাধনা ছিল গীতার বাণীকে সাধারণের জীবন ও কর্মে ছড়িয়ে দেওয়া। সবাই তা নিয়েছে। 
কিন্তু, আমি আজ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছি – মানছি তো??????? 
শেষ করছি ‘অর্ঘ্য’ পত্রিকায় ২০০৯ সালে লেখা সুকান্ত বাগচীর লেখা ‘কাচা-পাকার পুনর্মিলন’ নামক রম্য রচনার একটুকু অংশ দিয়ে । সুকান্ত বাগচী লিখছেন –যেখানে পাকা বলছে - “তিনি যে শিষ্যের হাত ধরে ভগবানের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন, তারই প্রতিদানে পূজার ছলে ভক্তেরা তার পা ধরে টেনে ফেলে দিতে চায়।“ 

চলবে…

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad