বাবাজী বারবার বলেছেন- অন্যের দোষ না দেখে নিজেকে ভালো করে দেখো, উত্তর পেয়ে যাবে

বাবাজী বারবার বলেছেন- অন্যের দোষ না দেখে নিজেকে ভালো করে দেখো, উত্তর পেয়ে যাবে


যেমন আমরা সিসিটিভি সারভিলেন্সের মধ্যে থাকি, ঠিক সেইরকমই গুরুদেবের অনির্বান নজরে আছি। আর একটা বলে আজকের লেখা শেষ করব। সেটা হলো – মৃত্যুর পর কী হয়, সেটা আপনিও জানেন না, আমিও নয়।
তারক ঘোষ

 পর্ব ৩৬ 

 আমাদের চোখ থাকতেও দেখতে পাই না। কান থাকতেও শুনতে পাই না। মন থাকলেও অনুভূতি থাকে না। আর এভাবেই আমরা অমূল্য বহু কিছু হারিয়ে ফেলি আর পরে আফশোস করি। কিন্তু, শোনার সময়ে যদি শুনতাম, তাহলে আফশোসের আর জায়গা হত না। 
শ্রীবাবাজী পাঠচক্রে বসে বহু অমূল্য কথা বলে যেতেন। পুরাণ, গীতা বা ভাগবত পাঠের মধ্য দিয়ে আধুনিক জীবনের বহু সমস্যা তিনি আলোচনা করতেন। সেই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার উপায়ও বলতেন। হয়, আমরা সে সব কথা মন দিয়ে শুনি নি, বা শুনলেও পালন করার কথা ভাবি নি। তাই ‘সাময়িক সমস্যা’র ‘সাময়িক মুক্তি’র জন্য ছুটে যেতাম বাবার কাছে। 
বাবা বারবার বলতেন – মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। ছেলের স্বাস্থ্য, ছেলের লেখাপড়া, ছেলের চাকরি, তারপর ছেলের বিয়ে, তারপর বৌমার সঙ্গে মানিয়ে চলার সমস্যা, তারপর নাতি নাতনি, তাদের স্বাস্থ্য, লেখাপড়া…… এর শেষ নেই। এ থেকে মুক্তি নেই। 


অথচ, সংসার জীবনে কিছু সমস্যা থাকবেই। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে গেলে আগে নিজের জীবনের দিকে তাকাতে হবে। আমি কীভাবে চলি, আমার ভুল-ভ্রান্তি কিছু আছে কিনা, সেটা দেখা দরকার। বৌমা আর শাশুড়ীর সম্পর্কে কেন অবনতি হবে, কেন ছেলে-বাবার মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হবে, কেন ছেলে-মেয়েরা বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখবে না – এই সমস্যার বীজ কিন্তু লুকিয়ে থাকে নিজেদের অতীত জীবনের মধ্যে। অথচ, নিজেদের অতীত কর্মকে না ভেবে, আমরা দোষ দিয়ে যাই অন্যের। 
এই ‘অন্যের দোষ’ দেখা মানুষের ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি। আমি বহুবার বাবার কাছে বসে শুনেছি, বাবাজী অতি সুন্দর ভাবে নানা গল্পের মধ্য দিয়ে সংসারী মানুষজনের নানা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ বাতলে দিতেন।
 কিন্তু, আমরা এমন নির্বোধ জীব – স্থায়ী কিছুতে বিশ্বাসী নই। অস্থায়ী জিনিস নিয়েই মাতামাতি করতে ভালোবাসি। নিজের স্থায়ী স্ত্রী বা স্বামী ছেড়ে অন্য নারী বা পুরুষের দিকে মন দিয়ে ফেলি। সেসব যে অস্থায়ী ও দুঃখের কারণ, আমরা যখন ঠেকে শিখি, তখন ফেরার পথ প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। বাবা বলতেন – “যে পিতা-মাতা মিথ্যা কথা বলতে পছন্দ করেন, সেই পিতা-মাতা শিশুকে সত্যবাদী করে তুলতে পারেন না। যে পিতা-মাতা বিবাদ/ঝগড়া পছন্দ করেন, তাদের শিশু সাধারণতঃ বিবাদী হয়ে পড়ে। অসংযত জীবনযাপনকারী পিতা-মাতার শিশুরাও অসংযত হয়ে পড়ে। শিশুর কারণে পিতা-মাতাকে সংযত হতে হয়।“
আজ আমার ছেলে আমাকে দেখছে না বলে কেঁদে কী হবে- ছেলেকে মানুষ করার সময় আমরা তাকে টাকা তৈরির মেশিন বানিয়ে ফেলি। মানুষের প্রতি নীতি-কর্তব্য আদর্শ, গুরুজনদের প্রতি, দাদু-ঠাকুমার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা না শিখিয়ে একটা রোবটে পরিণত করে ফেলি, ভাবি না পৃথিবীটা গোল। 
এই পৃথিবীতে শব্দের মৃত্যু নেই। শব্দ ব্রম্ভ। যে কটু কথা আজ আমি অন্যায়ভাবে অন্যকে বলছি, সেই কথায় তিনি যদি আঘাত পান, তাহলে, একদিন অন্য কেউ সেই কটু কথা আমাকে ফিরিয়ে দেবেই। কাজেই আজ যে কাজ আপনি করবেন, সেই কাজের ফল আপনার জন্যই তোলা থাকবে। এর থেকে পরিত্রাণ নেই। 
তাই বাবা বলতেন, “যে কাজ করলে ভগবান প্রসন্ন থাকে, সেই কাজ কর।“ আমার মনে হয়। এই ভগবানকে প্রসন্ন রাখা অর্থাৎ নীতিগতভাবে সঠিক, সেই কাজ আমরা করি, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ আমাকে আঘাত করতে পারবে না। আমি যদি কাউকে দুঃখ না দিই, তাহলে আমি দুঃখ পাব না।
 আর একটি কথা বাবা বলতেন। কেউ যদি অন্যায় না করে দুঃখ পান বা কষ্ট ভোগ করেন, তাহলে জানবি, তার পিছনে ঈশ্বরের লীলা আছে। বাবা বলতেন – “আমাদের কাছে টানবেন বলেই তিনি বঞ্চিত করেন। তীব্র নিন্দা দুঃখ অপমান দিয়ে তিনি কাছে টানেন। তাই বিনা কারণে আমাদের জীবনে যখন নিন্দা অপমান আসে তখন বুঝে নিতে হয় যে তিনি কাছে টানছেন” আর একটি কথা তিনি বলতেন, “অনুগত জনকে তিনি ত্যাগ করেন না। বরং ধীরে ধীরে আগুনে পুড়িয়ে তাকে খাঁটি সোনায় পরিণত করে নেবেন।“
অনেকে ভাবতে পারেন, ‘আমি তো কাউকে কষ্ট দিই নি, তাহলে, আমি আঘাত পাচ্ছি কেন?” এইখানেই একটা বড় প্রশ্ন আছে। সেটা হলো, নিজের অতীত জীবনের পর্যালোচনা। কোথাও কোন ভুল আছে কি না সেটা দেখা। অন্যকে দোষ না দিয়ে নিজের জীবনচর্চার ময়নাতদন্ত করে দেখা। আর একটা দিক আছে, একশ্রেণির মানুষ আছেন, তারা কোনদিন নিজের কাজে ভুল দেখেন না। কিংবা দেখতে পান না। এরা হয় অহঙ্কারী, নয় বোকা। নিজের কূয়োয় নিজেই বন্দী। 
স্বামী বিবেকানন্দের বলা সেই কূয়োর ব্যাং এর মতো। তার জগতের বাইরে আর কোন জগত থাকতে পারে, সেটাই সে বিশ্বাস করে না। এরা একেবারেই বদ্ধ জীব। এদের জীবনে কষ্ট আসবেই। আর এক শ্রেণি – সেটা হল অহঙ্কারী। নিজের অহঙ্কার করার কিছু না থাকলে, এরা আত্মীয়স্বজন্দের অহঙ্কারে গরবিত হয়। এই জানিস, আমার পিসীর ননদের ছেলের বৌএর মাসী বিরাট নেত্রী, কিংবা, আমার শালার বন্ধুর দিদি বিরাট অভিনেত্রী। এরা ধার করা অহঙ্কারে অহঙ্কারী হয়ে অন্যের পরিবারের দুর্বল সদস্যদের বিঁধতে ছাড়েন না। 
 বাবা বলতেন, “ভগবান সব ক্ষমা করেন, অহঙ্কারকে নয়। আর তিনি ভক্তির উদ্দামতা পছন্দ করেন না। ভক্তির সংহত রূপ ভালোবাসেন।“
বাবাজী বলতেন, ভগবানকে চোখে দেখা যায় না বলে, অনেকেই তার অস্তিত্বকে মানে না। এটা ভুল। ভগবান ভিন্ন ভিন্ন বেশে আপনাকে দেখে যান, তার চোখ আপনাকে সর্বক্ষণ দেখে যাচ্ছে।“ আজ আমার মনে হয়, আমাদের বাবাও সর্বক্ষণ আমাদের দেখছেন। 
আজ অনেকেই বাবা নেই বলে ভাবেন। তাদের বলি, বাবা আজও আমাদের মধ্যেই আছেন। তাকে আমরা ডাকার মতো ডাকতে পারি না, আমরা মনে করি, তিনি যেহেতু দেহে নেই, তাই আজ যা কিছু আমরা করতে পারি। নিজের জন্মদাতা পিতার প্রতি যেমন দায়িত্ব পালন করি, তার চেয়েও বেশি। কেননা, তিনি আমাদের ভালো আর খারাপ চিনিয়েছেন। তিনি আমাদের দুঃখ থেকে স্থায়ী পরিত্রাণের রাস্তা দেখিয়েছেন। আমরা যদি তার কথা সকলকে বলে, তার আদর্শকে প্রচার করি, অনেকটাই হয়। 
 এই প্রসঙ্গে বলি, আমাদের বাবা আমাদের দেখছেন – প্রতিটি কাজ – একবার তিনি যার দায়িত্ব নিয়েছেন, তাকে তিনি ছাড়েন না। যেমন আমরা সিসিটিভি সারভিলেন্সের মধ্যে থাকি, ঠিক সেইরকমই গুরুদেবের অনির্বান নজরে আছি। আর একটা বলে আজকের লেখা শেষ করব। সেটা হলো – মৃত্যুর পর কী হয়, সেটা আপনিও জানেন না, আমিও নয়।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad