শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ২৯

একদিকে নির্জনতার সন্ধান, অন্যদিকে অসংখ্য বন্ধন

 তারক ঘোষ

পর্ব  ২৯

 কবিগুরু বলেছেন – 

"বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়,
 অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ।"

 বাবাজী নিজে সাধক হলেও মনে করতেন, গৃহী মানুষ চাইলে সাধনপথে অনেকদূর এগোতে পারেন। কারণ, তারা সংসার জীবনের অসংখ্য বন্ধনে আবদ্ধ থেকেও যদি ভগবানকে ডাকার সময় করে নিতে পারেন, তাহলে সেটার তূল্য সাধন আর কিছু হতে পারে না। একইসঙ্গে তিনি শ্মশান বৈরাগ্যকে পছন্দ করতেন না। 
বার বার বলেছেন, তোরা যখন এখানে আসিস, আমার কথা শুনিস, ভালো লাগে। ভাবি তোরা জীবনে সেগুলো পালন করবি। কিন্তু, কিছুদিন পর যে কে সেই। মনে রাখিস, বৈরাগ্য ভালো, কিন্তু শ্মশান বৈরাগ্য নয়। মনটাকে বিরাগী কর, আচরণে বৈরাগ্য আন, কিন্তু বসনে বৈরাগ্য আর চিন্তায়-চেতনায় বিষয়াসক্তি মটর দানার মতো গজগজ করবে, তাহলে কিছু হবে না। 
একইভাবে সাধুগণের উদ্দেশ্যেও বলেছেন – “সাধু যদি জপ, ধ্যান না করে বা ঈশ্বরকে না ডাকে তবে কেবলমাত্র বৈরাগী, মহন্ত পদবী বা জটাদাড়ি, বেশভূষার দ্বারা সে যথার্থ সাধু হতে পারে ন।“ 
কিন্তু, কেন বাবাজী এই কথা বলতেন? 
নিশ্চয় তিনি এমন কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন বা গিয়েছিলেন, যা তার চিত্তকে অশান্ত করেছিল, সাধু সমাজের একটা অংশের জীবন-যাপন তাকে ব্যথিত করেছিল, তাই তিনি ওই কথা বলেছিলেন। বাবাজীর হৃদয়ে যদি সংষ্কারী মনটা না থাকত, তাহলে তিনি ওই কথা বলতেন না। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ক্রমশঃ তিনি জড়িয়ে যাচ্ছেন, এমন কিছু কর্মযজ্ঞে, যা তার সাধন পথে বাধা হতে পারে। মন্দিরের বিস্তার হোক, এটা অনেক সাধকই চান না, বাবাজীও এই নিয়ে অনেক ভেবেছেন। তার মুখেই শুনেছি। এসব কথা কাউকে কোনদিন বলেন নি। 
আমার স্ত্রী একবার বাবাজীকে জিজ্ঞাসা করবেন ভেবেছিলেন, “ বাবা, আজকাল, আপনাকে এরকম লাগে কেন? মনে হয় সবসময় কী এক চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।“ এই কথাগুলো সম্ভবতঃ ২০১২-১৩ সালের। যে বাবাজীকে আমরা দেখে এসেছি প্রাণোচ্ছল এক মহামানবরূপে, তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছিল, অন্ততঃ আমাদের ধারণা। 
 এসব নতুন মন্দির স্থাপনের ঠিক পরের কথাই। বাবাজী একবার পাঠচক্রে বসে আচমকাই উদাস হয়ে যান। তারপর বলে ওঠেন সাধুদের বড় কষ্ট। বাবা কেন বললেন সেকথা, আমাদের কারোরই জিজ্ঞসা করার সাহস ছিল না, তাই জিজ্ঞাসা করতে পারিনি।
২০১২ সালে আমি একটা ম্যাগাজিন প্রকাশ করি। কমার্শিয়াল সাহিত্য ম্যাগাজিন। সেখানে বাবা লিখতেন – আমাদের অনুরোধেই বাবা লেখা দিতে রাজী হয়েছিলেন। প্রথম সংখ্যা নিয়ে গেছি, বাবার হাতে তুলে দেব বলে। তারপর ম্যাগাজিন চলে যাবে ডিস্ট্রিবুটারের কাছে। তারপর সেখান থেকে স্টলে স্টলে প্রচারিত-বিক্রি হবে। 
বাবার হাতে দিলাম ম্যাগাজিন। বাবা উল্টে-পাল্টে দেখে বললেন, ভালো হয়েছে। সেদিন আর আশ্রমে থাকার সময় ছিল না। ফিরে এসেচিলাম। 
আসার পথে আমার কাছে একটা ফোন আসে। সেখানে নাম প্রকাশ না করেই এক ব্যক্তি আমাকে হুমকির স্বরে বলতে থাকেন, আমি ম্যাগাজিনে বাবার লেখার সঙ্গে কেন, ‘কানাগলি’ নামক গল্পটা দিয়েছি। তাকে আমি ভদ্রভাবে বিনয়ের সঙ্গে বলি, “আপনি যে গল্পটার কথা বলছেন, সেটা এক পতিতার জীবন ও সেখান থেকে উত্তরণের কথা বলা হয়েছে। যে একদিন সমাজের অসৎ ব্যক্তিদের দ্বারা পতিতালয়ে বিক্রি হয়েছিল, হাজারো নির্যাতন আর নারীত্বের অপমান সহ্য করতে হয়েছিল তাকে, সে কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে, অন্যরা যাতে এই বিপদে না পরেন, তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিল। 
এটা এক মানবতার উত্তরণের গল্প, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গল্প।“ তিনি তখন বলেন, যে বইতে জানকীদাসজীর কথা আছে, বাবাজীর লেখা আছে, সেখানে ওই গল্প ছেপে আপনি তাদের অসম্মনা করেছেন। আমি তখনো উত্তেজিত হই নি। 
সবিনয়ে বলি, ঠাকুর রামকৃষ্ণও নটী বিনোদিনীকে ঘৃণা করেন নি, তাকে ঠাঁই দিয়ে ছিলেন, শ্রীচৈতন্যদেব জগাই-মাধাই এর মতো মানুষকে সুপথে এনেছিলেন। তবে, আপনি যদি, এতে মনে দুঃখ পেয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে অনুরোধ করব, আমাদের মহাকাব্য মহাভারত টাও একটু ভালো করে পড়ে দেখার জন্য, কোনারকের সূর্য মন্দিরের ভাস্কর্য গুলো দেখার। 
আসলে, কারো মনটা যদি ‘নোংরা’ হয়ে যায়, তিনি তখন আর ভালো দেখতে পান না। আর আপনাকে জানিয়ে রাখি, আপনার চেয়ে বাবাজীকে নিশ্চই বেশী জ্ঞানী বলে মনে করেন, যদি করেন, তাহলে জেনে রাখুন আপনি যেই হোন না কেন, তিনি এ নিয়ে কিছু বলেন নি। কারণ তার হৃদয় অনেক বিরাট, আর আপনার হৃদয় এখনো পাঁকের মধ্যেই ডুবে আছে।“ 
ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ওই ব্যক্তির পরিচয় আমি কোনদিন জানতে পারিনি। কিন্তু, তিনি তার শেষ কথায় বলেছিলেন, ঠিক আছে, দেখা যাবে।“ জানিনা, তিনি কে? তবে, এই শ্রেণির মানুষের দেখা পরবর্তীকালে আমি অনেক পেয়েছি। বাবাজীর কাছে থাকা বহু মানুষকে দেখেছি, যারা নিজেদের স্বার্থের কথাই বেশি ভাবতেন। আমি তাদের নাম করছি না। আর সকলকে এই কথা বলছি না। 
কাজেই, কেউ যদি নিজেই এই কথাগুলো গায়ে মেখে নেন, তাহলে সেটা তার দায়িত্ব, আমার নয়। বাবাজী অনেক কিছুই মেনে নিতে পারতেন না, তাই পাঠচক্রে বসে, বলে ফেলতেন সে কথা। সামাজিক অবক্ষয় বাবাকে দুঃখ দিত, সমাজের সংযমহীনতা বাবাকে ব্যথিত করতো, ধর্মের নামে উন্মাদনা ওনার মনকে কুরে কুরে খেত। 
তাই তিনি বলতেন – “মূর্তি পূজার আসল লক্ষ্য ভুলে গিয়ে আমরা মূর্তি পূজার নামে প্যান্ডেল বানিয়ে মদ্য পান করছি। উচ্ছৃংখলতা করছি। এটা সনাতন ধর্ম নয়। সনাতন ধর্মকে সব দিক থেকে  কলুষমুক্ত করার সাধনা ছিল বাবার। তাই বারে বারে প্রতিবাদী হয়েছেন, তার কন্ঠ থেকে বার বার ধ্বনিত হয়েছে সেই শব্দগুলি – শান্ত না হলে শান্তি পাওয়া যায় না।
এই শান্তি পথের সন্ধানেই ছিলেন আমাদের বাবাজী। চারিদিকের উন্মাদনা তিনি পছন্দ করতেন না, কেননা তিনি ছিলেন প্রকৃত ‘মানুষ গড়ার কারিগর’, তাই মনের সংষ্কার সাধনের কথা বার বার বলতেন। একবার আশ্রমে আছি। এক মহিলা এসে বাবাকে বললেন, বাবা আমার ছেলেকে একটু মুখে ভাত দিয়ে দিন। বাবা সেদিন কোন কারণে সেই কাজটা করতে চাইছিলেন না।
 এদিকে ওই মহিলাও ক্রমশঃ জোড়াজুড়ি বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। বাবা বলছেন, দেখ আমাকে জোর করিস না। সেই মহিলা জোর করেই তার ছেলেকে বাবার কোলে দিয়ে দিলেন। বাবা সেদিন বলেছিলেন “তোদের জ্বালায় আমাকে চলে যেতে হবে।“ বাবাকে যেন ক্রমশঃ বন্ধনে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছিল। নানা সমস্যা উপস্থিত হচ্ছিল। যে মহা-সাধক সাধনপথ আর ধর্মীয় কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিয়োজিত রাখার পাশাপাশি সমাজ সংষ্কারের কাজ করতে চেয়েছিলেন, তাকে জোর করে সাংসারিক জীবনের কিছু কাজ করানো হত। আমার তাই মনে হয়েছে।
তিনি নিজে অর্থ স্পর্শ করতেন না, কাউকে বলতেন টাকা তুলে রাখতে। অর্থ জীবন চালায়, কিন্তু জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না- এই বিশ্বাস তিনি করতেন। আমারও মনে হয়, অর্থ যখন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে, তখনই শুরু হয় অন্য কিছুর। 
বাবাকে একবার একটা গীতা আর দুটি কলম দিয়েছিলাম। ওক কাঠের বাক্সে ভরা সেই গীতা আর কলমগুলিকে বাবা বুকে তুলে নিয়ে তার ঘরে চলে গিয়েছিলান, একথা আজও আমার মনে জ্বলজ্বল করছে।
 আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad