ত্যাগঃ সন্ন্যাসীর কাছে ব্রত আর গৃহীর কাছে ভাল থাকার ‘পাসওয়ার্ড’

তারক ঘোষ 

 পর্ব ৪৩ 

 গৃহীরা যদি, বিষয় বাসনার দিকে ধাবিত না হয়ে, অন্যকে হিংসা করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। পরালোচনা, অন্যকে অন্যায়ভাবে দুঃখ দেওয়া, অন্যের সম্পত্তিতে লোভ না করা- এই খারাপ বিষয়গুলি ত্যাগ করতে পারেন, তাহলে তিনি নিশিন্ত ঘুম লাভ করবেন, ভুগতে হবে না ব্লাড-সুগার, উচ্চ-রক্তচাপে


 মাত্র দু-অক্ষরের একটা শব্দ, অথচ এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সন্ন্যাস আর গৃহ জীবনকে সফল করার মূলমন্ত্র। কত সহজে অনেকে এই ‘ত্যাগ’ শব্দটি উচ্চারণ করেন, কিন্তু, তিনি হয়তো জানেন না, মানুষের জীবনে এই ‘ত্যাগ’ শব্দটি কত গুরুত্বপূর্ণ। 
আমরা দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছুই ত্যাগ করি। কেউ প্রেমিক বা প্রেমিকা ত্যাগ করেন, কেউ স্বামীকে, কেউ বা স্ত্রীকে । কেউ দেশের জন্য জীবন ত্যাগ বা দান করেন, কেউ জীবনের মানে খুঁজে না পেয়ে জীবনটাই ত্যাগ করে দেন। 
অর্থাৎ চারিদিকে এই ‘ত্যাগ’ এর নিদর্শন। 
সন্ন্যাসী তার পূর্ব আশ্রমের নাম, গৃহ, পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে নতুন নামে পরিচিত হন। গৃহী মানুষরাও নানা সময় ত্যাগ স্বীকার করেন। অনেক গৃহী হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, সবই যদি ত্যাগ করে দিই তাহলে, নিজের চলবে কীভাবে?
 একেবারে সঠিক প্রশ্ন। কিন্তু, কী ত্যাগ করতে হয়, এটা না জানলে, তিনি তার প্রশ্নের উত্তর পাবেন না। যে জিনিষগুলি আমাদের চিরন্তন দুঃখের কারণ, সেগুলিই ত্যাগ করতে হবে। কী সেই চিরন্তন দুঃখের কারণ?
সন্ন্যাসীরা সংসার ত্যাগ করেন, দুঃখের কারণ থেকে মুক্তি খুঁজে ঈশ্বরের সাধনা করার জন্য। সকল মানুষের মঙ্গল সাধনায় তারা তাদের জীবন ও মন উৎসর্গ করেন। ভোগবিলাস থেকে মুখ ফিরিয়ে তারা মন সমর্পন করেন ঈশ্বরের পদতলে। অর্থের দিকে ফিরেও তাকান না। মনের মধ্যে তাদের থাকে না কোন লোভ, হিংসা, কামনা বা বিত্ত-বাসনা। সবকিছু পার্থিব লোভের বিষয় ত্যাগ করে তারা হয়ে ওঠেন সর্বত্যাগী। ত্যাগই তাদের ব্রত, ত্যাগই তাদের মুক্তি। 
তাই, সর্ব-বন্ধন ত্যাগ করে তারা হয়ে ওঠেন আমাদের প্রণম্য। 
আমি এরকম বহু সাধুকে দর্শন করেছি কুম্ভে, জয়দেবের মেলায়, গঙ্গাসাগরে। এই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা ব্যবহার করেন না আধুনিক জীবনের কোন উপকরণ, পরনে সামান্য কমদামী বস্ত্র, আর সঙ্গী গ্রন্থ। এদের কোন আশ্রম নেই নিজেদের। বসুন্ধরার সব জায়গাই এদের আশ্রম। মুক্তি সাধনার এই পথিকদের 

পাশাপাশি দেখেছি ‘ধনী’ সাধুদের বিলাসময় জীবন। কামিনী-কাঞ্চনে তীব্র আসক্তি। হাজার হাজার ধনী শিষ্যা পরিবৃত এই সাধুদের ঝা চকচকে আশ্রম। সিকিউরিটির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, আধুনিক জীবনের ঢালাও উপকরণ। 
এই ‘ত্যাগী’ দের দেখে সাংবাদিক হিসাবে মনে প্রশ্ন এসেছিল –“এরা তাহলে কী ত্যাগ করলেন?”
শ্রীবাবাজী মহারাজ দাদাজী মহারাজ প্রসঙ্গে বলছেন – “শ্রীগুরুজীর সামনে ভোগের সমস্ত সুযোগ থাকলেও, তিনি সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে গেছেন। বড়ল আশ্রমে তিনি বাকি জীবন সাধারণ খড়ের চালের ছোট্ট কুটিরের মধ্যে বাস করে গেছেন। ভক্তরা ভোগ-বিলাসের জিনিস দিলেও তিনি তা ব্যবহার করতেন না। তিনি ছিলেন জন্ম সাধু।“ 
 আমার খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি, পার্থিব সমস্ত ‘সুখ-ভোগ’ এর জন্য লালায়িত হয় এক শ্রেণির ‘সাধু’ রা। কামিনী নিয়ে চলে বিলাস। পরিণতিতে কেউ জেলে যান, কেউবা ধরা না পড়ায় সেই কাজই চালিয়ে যেতে থাকেন। এরা বোঝেন না, ঈশ্বর কিন্তু দেখছেন। ষোল-কলা পূর্ণ হলেই, কেউ না কেউ আদালতে যাবেন, ধরিয়ে দেবেন এই সমস্ত কামিনী-কাঞ্চনে আকৃষ্ট তথাকথিত একশ্রেণির ‘সাধু’দের।
বাবাজী’সত্যের জয়’ প্রবন্ধে লিখছেন –“মহন্তাই এইসবে তার কোন আগ্রহই ছিল না। আজ অনেক কাঠিয়াবাবার আশ্রিতরা সবই রেখেছেন। কেবল কাঠিয়াবাবকেই বাদ দিচ্ছেন। কাঠিয়াবাবা সাধনার যে সপ্তভূমির কথা বলেছেন, তার প্রথম ভূমিটি হলো, ‘গুরুতীর্থে অনুরাগ বিষয় বিষ কর মান।‘ বর্তমানে কাঠিয়াবাবা নামধারী অনেককেই যদি এই কথা জিজ্ঞাসা করা হয় যে, বিষয়কে বিষ জ্ঞান হয়েছে কি না, তবে উত্তর ওই একই হবে। বর্তমান কালে এই সব চলে না। কিন্তু, শ্রীশ্রী সন্তদাসবাবাজী মহারাজ লিখেছেন –‘সাধু কেবল নিজে নির্দোষ থাকলেই চলবে না। বাইরের লোকও যাতে দোষ আশঙ্কা করতে না পারে, এরূপ আচরণ করা ঠিক নয়। বাইরের ঠাট হয়তো বজায় থাকবে, কিন্তু, ভিতর শূন্য হয়ে যাবে।“
কাজেই, গৃহী মানুষের কাছে ‘ত্যাগ’ হলো ভালো থাকার পাসওয়ার্ড আর সন্ন্যাসীদের কাছে ব্রত। যিনি এই ব্রত সঠিকভাবেই তার জীবন ও দর্শন দিয়ে পালন করতে পারেন, তিনিই যথার্থ সর্বত্যাগী। 
আর গৃহীরা যদি, বিষয় বাসনার দিকে ধাবিত না হয়ে, অন্যকে হিংসা করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। পরালোচনা, অন্যকে অন্যায়ভাবে দুঃখ দেওয়া, অন্যের সম্পত্তিতে লোভ না করা- এই খারাপ বিষয়গুলি ত্যাগ করতে পারেন, তাহলে তিনি নিশিন্ত ঘুম লাভ করবেন, ভুগতে হবে না ব্লাড-সুগার, উচ্চ-রক্তচাপে।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad