সব জল শুকিয়ে গেলেও চোখের জলে ফোটে ফুল। বাবাজী মহারাজের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এই কথাটা লিখে ফেললাম।
তারক ঘোষ
ওই লেখার একটা কারণ আছে। চারিদিকে যখন দেখবেন, সবাই আপনার বিরুদ্ধাচরণ করছে অন্যায়ভাবে, যখন দেখবেন আপনার সব পথ আপাতদৃষ্টিতে রুদ্ধ হয়ে গেছে, উঠে দাঁড়াবার মতো এক টুকরো মাটির অবলম্বনও আপনি পাচ্ছেন না, তখন ওই কথাটা মনে রাখবেন।
একদিনের কথা। কথাটা শুনেছিলাম বাবাজী মহারাজের এক বিশেষ ভক্তের কাছে। যিনি বাবাজী মহারাজকে অনেক কাছ থেকে সুদীর্ঘ সময় ধরে দেখেছেন, তার কাছে অনেক কথাই বলেছেন।
তখন আশ্রমে ভোর হয়েছে। একটি ছোট ছেলে হাতে হারিকেন আর গীতা নিয়ে আসছে। বাবাজীর কাছে গীতার পাঠ আছে, সেই কারণেই। আচমকাই সে মাটিতে পড়ে যায়। হারিকেন এক দিকে, আর অন্যদিকে গীতা।
সেই ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি উঠতে যান, ছেলেটিকে মাটি থেকে তোলার জন্য। বাবাজী মহারাজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “তুই বস। ও নিজেই করবে।“
এরপর ওই ছোট ছেলেটি মাটি থেকে প্রথমে গীতা, পরে হারিকেনটা তুলে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বাবার কাছে এসে প্রণাম করে।
বাবাজী এটাই চাইতেন। কাউকে বলতেন না –‘আমায় হাওয়া কর।‘ আবার কেউ তার পাশে দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে শুরু করলেও, তাকে খুব একটা থামতেও বলতেন না। বহু সময় ছোট ছোট ছেলেরা বাবাজীকে পাখার বাতাস করত। বাবাজীর জটা খুলে দিতে সাহায্য করত। ঠিকমতো না হলে, বাবাজী তাদের বকতেন বা ক্ষেত্রবিশেষে মারতে যেতেন। আসলে, তিনি এই বিষয়গুলিকে কর্ম হিসাবে দেখতেন। কর্মযোগ।
তাই বহবার বলেছেন – কর্ম ছাড়তে নেই। কর্ম করলে জ্ঞান আসে, জ্ঞান থেকে বুদ্ধি… শৈশব অবস্থাই যে শিক্ষার সেরা সময়, এটা বাবাজী বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন বারেবারে।
একজন ভালো মানুষ হতে গেলে তার একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন নীতিশিক্ষারও। কর্মের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। আর কর্মে ভুল হলে, তবেই মানুষ ঠিক কোনটা বুঝতে শেখে। বাবাজী মহারাজ বারবার বলতেন, সাধুদেরও শিক্ষিত হতে হয়। শিক্ষার আলোয় নিজে আলোকিত না হতে পারলে, অন্যকে আলো দেখানো যায় না।
বাবাজী মুখে অনেক কথাই বলতেন না, কিন্তু তার আচরণের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন, কী করা উচিত, আর কী করা উচিত নয়।
আর একটি কথা বাবাজী কারো কারো কাছে বলেছেন – “মনে কর, আমার চার ছেলে, এদের তিনজন ভালো, সৎ, আর একজন খারাপ, অসৎ, আমি কি করব? ওই চতুর্থ ছেলেকে তাড়িয়ে দেব?”
এটাই বাবাজীর জীবনে একটা প্রশ্ন ছিল?
তিনি কেন এই কথাটা বেশ কয়েকবার বলেছেন, তা আমরা জানি না। তিনি জানতেন আর যদি কারো সম্বন্ধে বলে থাকেন তিনি জানেন।
তবে, বাবাজীর লেখা ‘গুরু লাভ’ নিবন্ধে বাবাজী বলছেন – নিজে মরিয়া গুরু শিষ্যকে বাঁচান। শিষ্যের যা কিছু মলিনতা, যতকিছু সন্তাপ, যতকিছু পাপ নিজে গ্রহণ করে নিজের পবিত্রতা, নিজের সাধনার পবিত্র আলোকে শিষ্যকে কৃতার্থ করেন। গুরু শিষ্যকে কী দেন, সেকথা আর বলা চলে না। যে শিষ্য, সে প্রাণে প্রাণে বোঝে।‘
বাবাজী মহারাজ ‘সত্যের জয়’ নিবন্ধে লিখেছেন –‘সাধুতো নির্বিরোধী হয়। আমরা কি আমাদের পরম্পরার পুরুষদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করব না?’
জানকীদাসজী মহারাজ বলতেন –‘দুই নিয়া দুনিয়া। এখানে যেমন সৎ আছে, সেরকম অসৎ আছে। মাৎসর্যপরায়ণ, পরশ্রীকাতর, কর্তৃত্বাভিমানী ব্যক্তিরও এখানে অভাব নাই। সৎ লোকেরা চিরকাল এই শ্রেণির লোকেদের দ্বারা কষ্ট পেয়ে এসেছেন। তবুও তারা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজেদের আদর্শ ত্যাগ করেন নি।‘
বাবাজী জীবন গঠনের শিক্ষক ছিলেন। জীবনের মূল উদ্দেশ্যকে যদি বোঝা না যায়, তাহলে, সেই জীবন তার মূল্য পায় না। তাই জীবনের শুরুকে অর্থাৎ শৈশবকে বাবাজী বেছে নিতেন, কর্ম আর শিক্ষার শুরু হিসাবে।
রাধামাধবজী নামে এক ব্যক্তিকে আপনারা অনেকেই দেখেছেন। বলতে পারা যায়, আশ্রমে আগত সকলেই তাকে দেখতেন। ভোর তিনটে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নানা কর্ম করে চলেছেন হাসিমুখে। ভক্তদের কী প্রয়োজন, কোথায় থাকবেন, তারা কী খাবেন – সব তার মাথায়। বাবাজীর নির্দেশ পালনের অপেক্ষায় তার মন উন্মুখ হয়ে থাকত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বলি, ২০০৩ সালে যখন তাকে প্রথম দেখি, তখন তার বয়স বেশি নয়, কিন্তু উদ্যম ছিল বিরাট। বাবাজী তাকে বলছেন, ‘এই এটা কর, এই ওটা কর।‘ আর রাধামাধবজী তাই করে চলেছেন। বিশ্রাম নেই। একটু ভুল হলেই, বাবাজীর বকাঝকা শুনতাম।
এটা কর্মযোগ। কর্মে আসক্তি নয়, নিরাসক্ত হয়ে কর্ম করা। এর ফল কী হবে, সেটা ভেবে কর্ম নয়। আশ্রমে আগতছোট ছেলেমেয়েরা বাবার প্রবচন শেষের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকত। কেন জানেন?
পাঠ শেষ হলেই বাবাজী বলবেন – রাধামাধব, যা লজেন্সের বয়ামটা নিয়ে আয়। লজেন্স এলেই, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা দু হাত ভরে সেগুলো নিত। শিশুদের এই যে খুশি – বাবাজী সেটা উপভোগ করতেন। ফুরিয়ে গেলে আবার আনতে বলতেন।
তার মুখেও ছিল এক শিশুর হাসি – যে হাসি আজ দূর্লভ। এই হাসি আমি আর কারো মুখে দেখিনি। এক জ্ঞানী সন্ন্যাসীর মধ্যে কীভাবে এক শিশু লুকিয়ে থাকতে পারে, আজও ভেবে পাই না।
যদিও বাবাজীর জীবনের শেষপ্রান্তে, সেই হাসিটার মধ্যে আমি বিষাদের ছায়া দেখেছি। আমি এ ব্যাপারে একটুও ভুল করিনি।
তাই তিনি বলতেন কর্ম অভ্যাস করতে, সেখান থেকেই আসবে জ্ঞান আর বাস্তব বুদ্ধি। কর্ম ছেড়ে দিলে সব ছেড়ে দেওয়া হয়ে যায়। সব কাজকে শ্রীগুরুর কাজ বলে, কেউ যদি তার কর্ম করে, তাহলে সেখানে মনোযোগ যেমন থাকবে, ভুলের সম্ভাবনাও কম থাকবে। আর শৈশব হল কর্ম শুরু করার প্রকৃষ্ট সময়।