গুরুদেব এক শিষ্যের জীবনে ঠিক কী, সেটা বাবাজী বুঝেছিলেন। তাই তার জীবন চালিত হয়েছে শ্রীগুরুর পথ ধরেই। তিনি তার গুরুদেবকে অনুসরণ করেছেন, অনুকরণ করার চেষ্টা করেন নি। কারণ, সব কিছু অনুকরণ করা যায়, কিন্তু, জ্ঞান নয়। জ্ঞান আহরণ করার জন্য সার্বিক শিক্ষা আর সাধনা প্রয়োজন।
তারক ঘোষ
শিষ্য আর গুরুর মধ্যে এরকম বন্ধন খুব কমই দেখা যায়, যা দেখা গিয়েছিল স্বামী শ্রীজানকীদাসজী ও স্বামী শ্রীপ্রজ্ঞাদাসজীর মধ্যে। গুরুসেবা কী ও গুরুসেবার জন্য মনকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে হয়, বাবাজী মহারাজ ছিলেন তার আদর্শ উদাহরণ। এই নিবন্ধের কিছু তথ্যের জন্য আমি শিশির কুমার ঘোষালের লেখা ‘গুরু সঙ্গে নানা রঙের দিনগুলি’ গ্রন্থের কাছে ঋণী।
শিষ্য কি কখনো গুরুকে অতিক্রম করতে পারে? উত্তর হলো- না। শিষ্য গুরুর চেয়েও শিক্ষিত হলেও- না। কারণ, শিষ্য তিনিই, যিনি তার গুরুকে মস্তকে ও হৃদয়ে ধারণ করেই সমস্ত জাগতিক কাজ করে থাকেন। তাদের এক হাত থাকে শ্রীগুরুর চরণে, আর অন্য হাত থাকে কর্মে।
গুরুসেবায় বাবাজী মহারাজ কাটিয়ে দিয়েছেন, তার সারাটা জীবন। যেখানেই যেতেন, তার মুখে শ্রীগুরুদেবের নাম উচ্চারিত হতোই। সব কথাতেই তার ‘শ্রীবাবাজীর’ কথা আসতই। দাদাজী মহারাজ তার এই শিষ্যকে চিনে নিয়েছিলেন, সেই ছোট্ট অবস্থাতেই।
তাই, বাবাজীর সুখ ও দুঃখে সবসময়, তার পাশে থেকেছেন।
বাবাজী মহারাজ একবার তার গুরুদেব সম্পর্কে বলেছিলেন – দাদাজী মহারাজ তাকে একবার ধমক দিয়ে বলেছিলেন- “তুই মনে করেছিস, তুই আমাকে সবটা বুঝে ফেলেছিস?”
শ্রীগুরু যদি নিজে ধরা না দেন, কার সাধ্য তাকে বোঝার। আর এই ধরা তিনি সকলকে দেন না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পূর্ণরূপে নরেনের কাছে ধরা দিয়েছিলেন। আর ধরা না দেওয়া পর্যন্ত, নরেন সঠিকভাবে চিনতে পারেন নি দক্ষিণেশ্বরের এই ‘পূজারী ব্রাম্ভণকে’।
আর যেদিন ধরা দিলেন, সেদিন নরেন তথা স্বামীজী হয়ে উঠলেন, আধ্যাত্মিক ভারতের এক নব-রূপকার। আমাদের বাবাজী মহারাজের জীবনেও তাই ঘটে।
আমরা শিশিরবাবুর লেখা থেকে জানতে পারি । একবার এক প্রাক্তন শিক্ষকমশাই দাদাজীর কাছে নানা ধরণের কথা বলতে বলতে মন্ত্র-দীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
দাদাজী মহারাজ তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, তিনি কী বলেন সেই আশায়। সেই মাষ্টারমশাই বলতে থাকেন –“আমার মন্ত্র নেওয়ার খুব ইচ্ছা। কিন্তু, গুরুকরণ সম্পর্কে ঠিক সেরকম কাউকে চিনি না। আমার খুব ইচ্ছা প্রজ্ঞাদাসের কাছে মন্ত্র নিই।“
আসলে তিনি বাবাজী মহারাজ তথা প্রজ্ঞাদাসজীকে চেনেন, তাই ওকথা।
ওই ভদ্রলোক যখন এই কথা বলে তাকিয়ে আছেন দাদাজী মহারাজের দিকে, তখন বাবাজী মহারাজ একটু দূরে বাঁশের খুটি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আর দাদাজী মহারাজের কাছেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন শিশিরবাবু।
আর ওই ভদ্রলোক একবার দাদাজীর দিকে, একবার বাবাজীর দিকে তাকাচ্ছেন। ভাবখানা এমন – ভুল বলে ফেললাম না কি? আর ওই কথা শুনে বাবাজীর যে কী অবস্থা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারই গুরুর উপস্থিতিতে, তারই শিষ্যের কাছে মন্ত্র নিতে চাইছেন এক ব্যক্তি।
তিনি না পারছেন, চলে যেতে, না পারছেন স্থির থাকতে।
বাবাজী মহারাজ তার গুরুরদেবের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে সেদিন সেখানেই রয়ে গেলেন। জানকীদাসজী ওই ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললেন –“আচ্ছা, দেখা যাক।“
শ্রীদাদাজী মহারাজের ওই উত্তরের কী ব্যাখ্যা হতে পারে? ওই ব্যক্তির অজ্ঞতা? গুরুর সামনে শিষ্যের কাছ থেকে মন্ত্র নিতে চাওয়া? ভবিষ্যতের কোন গূঢ় ইঙ্গিত? না, সমস্তটাই একটা বালখিল্য ব্যাপার?
বাবাজী মহারাজ সব বুঝে গিয়েছিলেন সেদিন।
বুঝেছিলেন, তাকে এক বিরাট দায়িত্ব নিতে হবে ভবিষ্যতে। আর সে দায়িত্ব তাকে নিতে হয়েছিল। চোখের জলে গুরুর আশ্রম ত্যাগ করেও, তিনি সেই চোখের জলের মর্যাদা রক্ষা করে গেছেন। নিজের চোখের জলে শ্রীগুরুর পদযুগল ধুইয়ে দিতেন তিনি।
দাদাজী মহারাজের সততা, সাত্বিক জীবন, নির্লোভ এক মহাজীবন, সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, মহন্ত পদবীর মতো যাবতীয় পার্থিব সম্মান সম্পর্কে তার নির্লিপ্ততা, সন্ন্যাস সম্পর্কে তার স্বচ্ছ জ্ঞান, অগাধ পাণ্ডিত্য, বাবাজীকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল জীবনভর।
দাদাজী মহারাজ অর্থাৎ স্বামী শ্রী জানকীদাসজীর সামনেই এক ব্যক্তি বাবাজী মহারাজের কাছ থেকে মন্ত্র নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন।
গুরুদেব এক শিষ্যের জীবনে ঠিক কী, সেটা বাবাজী বুঝেছিলেন। তাই তার জীবন চালিত হয়েছে শ্রীগুরুর পথ ধরেই। তিনি তার গুরুদেবকে অনুসরণ করেছেন, অনুকরণ করার চেষ্টা করেন নি। কারণ, সব কিছু অনুকরণ করা যায়, কিন্তু, জ্ঞান নয়। জ্ঞান আহরণ করার জন্য। আর এর জন্য দরকার সার্বিক শিক্ষা আর সাধনা ।