বাবাজী বলেছিলেন, “মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না, কারণ জন্মের সময় যিনি আমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, মৃত্যুর পরের দায়িত্ব তারই।“

কৃষ্ণ শুধু কথায় নয়, কৃষ্ণ মনে, কৃষ্ণ চলায়, বলায়, সদাই কৃষ্ণ ধ্যান। রাধা-কৃষ্ণ যে ভক্ত আর ভগবানের মিলিত রূপ। ভারখন্ডে তিনিই ভক্তের ভার গ্রহণ করেন, ছত্রখন্ডে তিনিই ভক্তের মাথায় ছাতা ধরে থাকেন। আর বস্ত্র হরণের মাধ্যমে, তিনি ভক্তের শেষ টানটুকুও কেড়ে নেন। আর তারপরই জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন
তারক ঘোষ

বাবাজী কি জানতে পেরেছিলেন ধীরে ধীরে মৃত্যুরূপ অমৃত তাকে ঘিরে ঘিরে ধরে নিয়ে চলেছে পার্থিব লীলা সমাপনের শেষ লগ্নের দিকে? অক্লান্ত কর্মবীর, অকুতোভয় এই সত্যিকারের বৈষ্ণব ও সন্ন্যাসীকে মৃত্যু ঘিরে ধরেনি, ঘিরে ধরছিল এক আশঙ্কার কালো ছায়া। 
যারা বলেন, তার সব কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে তিনি স্বেচ্ছায় ফিরে গেছেন, তাদের সবিনয়ে বলি, তারা হয় অসত্য কথা বলছেন, অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ওই কথা বলছেন। কারণ তার কাজ সমাপ্ত হয় নি। অনেক কিছুই করার ইচ্ছা তার ছিল, শুধু ছিল নয়, ২৮ ফেব্রুয়ারী বৃন্দাবন রওনা হওয়ার আগে তিনি এই কথা অনেককেই বলে গেছেন। 
আমি বাবাজীর ‘খুব কাছের’ কিছু মানুষজনের মুখ থেকে এই কথা শুনেছি। আর একটি কথা বলি, বৃন্দাবন যাবার পথে বিহারের ঔরঙ্গাবাদের এক অবাঙালি শিষ্যের কাছ থেকে প্রসাদ পাওয়ার কথাও তার ছিল। তিনি সব ব্যবস্থা করেও রেখেছিলেন। 
কাজেই তার শেষ গন্তব্য নিরষার কাছে গোবিন্দপুর ছিল না, ছিল বৃন্দাবনই। তিনি সেই ঔরঙ্গাবাদের শিষ্যকে জানিয়ে দিতে বলেছিলেন, সেখানে যাবার সময় না পেলে পথেই প্রসাদ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে। ভাগ্যের পরিহাস! তিনি বৃন্দাবনে শেষপর্যন্ত পৌছেছিলেন, কিন্তু দেহে নয়।
সেসব কথা থাক।   কিন্তু, আবারও বলি, তার সব কাজ শেষ হয়নি, কেননা, এমন বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা তিনি তার ‘কাছের জনের’ কাছে জানিয়েছিলেন। সেগুলি তিনি  বৃন্দাবন থেকে ফিরে এসে করতেন। (অনেক অজানা কথা নিয়ে আমার পরের গ্রন্থ 'কেন এসেছিলেন' এ আমি লিখেছি)
বাবাজী অসমের ভক্ত সমাগমে একটা গল্প বলতেন – গল্পটা হয়তো শুনেছেন, তবু আর একবার বলি। 
‘শ্যামলী নামে একটা গাভী ছিল। বেশ নধর। বনের ধারে সবুজ ঘাসে সে চরে বেড়াতো। আর পাশের বনে ছিল এক বাঘ। শ্যামলীর নধরকান্তি চেহারা দেখে প্রায়ই তার জিভে জল আসতো। কিন্তু, সুযোগ আর হচ্ছিল না। তাই বাঘের মনটা ভালো ছিল না। 
কিন্তু, একদিন সেই সুযোগ এলো। আগের রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। শ্যামলী যেখানে চরতে যায়, সেই জায়গাটাতে বেশ কাদা হয়েছে, তার সঙ্গে পাশের পুকুরের পাঁকও মিশে গেছে। শ্যামলী চরতে চরতে গিয়ে পড়েছে সেই কাদার মধ্যে। আর নড়তে পারছে না। কাদা আর পাঁকে তার পা এমন আটকে গেছে যে, সে না পারছে এগোতে, না পারছে পিছোতে।
 বাঘ এতক্ষণ সব দেখছিল।এইবার বুঝল সেই মহাক্ষণ আগতপ্রায়। এইবার এসেছে সেই মহালগ্ন। শ্যামলীর মাংস ভক্ষণ করার সুবর্ণ সুযোগ। আর দেরি সে করল না। দিল বিরাট এক লাফ। তাকে লাফাতে দেখেই শ্যামলী বসে পড়ল সেই কাদার মধ্যেই। আর বাঘ গিয়ে কয়েক হাত দূরে কাদার মধ্যে গিয়ে পড়ল। যথারীতি সেও আটকে গেল কাদায়। 
এবার বাঘ আর গাভী প্রায় পাশাপাশি। দুজনেই মৃত্যুর দরজায়। অবস্থা বুঝে বাঘ বিনয়ের সুরে বললো –‘শ্যামলী আমরা দুজনেই তো মরতে বসেছি। তুই একটু গলাটা এগিয়ে দে। মরার আগে তোর রক্ত খেয়ে শেষ ইচ্ছাটা পূর্ণ করে যাই।‘
শ্যামলী বলে, ‘তোর মরার ইচ্ছা আছে মর, আমি মরছি না।‘
 বাঘ বললো, ‘কেন? তুই মরবি না কেন?’
 শ্যামলী হেসে বলে, ‘আমার মালিক আছে।‘
 বুঝে দেখুন, কী দর্শন – আমার মালিক আছে যে! 
বাঘ বললো, ‘তাতে কী?’ 
শ্যামলী বলে, ‘আমাকে ফিরতে না দেখে আমার মালিক আমাকে ডাকতে ডাকতে খুঁজতে আসবে। আমায় ডাকবে ‘শ্যামলী শ্যামলী’ বলে। আর আমি ‘হাম্বা হাম্বা’ করে তার উত্তর দিয়ে যাব। মালিক এখানে চলে আসবে,। তারপর আমাকে দেখতে পেয়ে মুগুর দিয়ে তোকে আগে পিটিয়ে মারবে। তারপর আমায় উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।‘ 
বাস্তবে হলও তাই। শ্যামলীর মালিক বাঘকে মেরে শ্যামলীকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল।
বাবা এই গল্পটা বলে বলতেন – একেই বলে শরণাগত। যে ‘মালিক’ তথা ভগবানের আশ্রয় পেয়েছে, তার ভয়ের কিছু নেই। মালিকই তাকে উদ্ধার করবে। ভক্তকে দাস হতে হবে। দাস কে? ভগবান যাকে যে অবস্থায় রাখেন, সেই অবস্থাতেই যিনি সন্তুষ্ট থাকেন, তিনিই দাস। শ্যামলী কাদার মধ্যে আটকে গিয়েও মালিকের কথা ভোলে নি। 
নিজের আমিত্বকে ত্যাগ করে, মালিকের অপেক্ষায় ছিল। মনে মনে মালিকের আগমন প্রার্থনা করছিল। মনের মধ্যে কোন ‘নেগেটিভ’ ভাবনাই রাখে নি, শুধু মালিককেই ডাকছিল। দাসের মধ্যেও এই লক্ষণ থাকতেই হবে, তবেই প্রভু আসবেন। 
বাবাজী বলতেন যার যেমন আঘাত ভগবান তাকে সেই ওষুধই দেন। যিনি অর্থের অভাবে কাতর, তাকে অর্থ দেন। যিনি পরনারী বা পরপুরুষে কাতর, তারা তাই পান। কিন্তু, অর্থ বা ‘অন্যায় প্রণয়’ যে যথার্থ সুখ দেয় না , সেটাও ভগবান সময়ে বুঝিয়ে দেন তাদের
। আর যিনি সর্ব অবস্থায় শুধু ভগবানকেই পেতে চান, তিনি সেটাই লাভ করেন। সেই ভক্ত বা শিষ্য তখন সবকিছুতেই সমদর্শী হয়ে যান। যিনি ধ্যান করতে করতে সত্য সত্যই সেই গভীর অবস্থায় উপনীত হন, তখন তিনি নির্বাক হয়ে যান। 
তাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন – সেই অনুভূতি কেমন? তিনি বলতে পারেন না। কেননা, যিনি সেই অবস্থা লাভ করেছেন, একমাত্র তিনিই বোঝেন মনের প্রশান্তি ঠিক কী জিনিস, কেমন তার অনুভব। বাবাজী মহারাজ ছিলেন প্রকৃত বৈষ্ণব।
 তাই তিনি অনায়াসে বলতে পেরেছিলেন – ‘আমি আপনাদের পায়ের ধুলোর যোগ্য নই। আপনারা আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছেন বলেই আমি বলছি। এটা আপনাদের মহানুভবতা।‘
কতজন সন্ন্যাসী এ কথা বলতে পারেন? কতজন সন্ন্যাসী তার ভক্তদের নিজ-সন্তানের চেয়েও কাছের বলে ভাবতে পারেন। কতজন সন্ন্যাসী মনে করেন, তাদের কাজ শুধু ধর্মের কথা বলা নয়, ধর্মের স্বরূপকে সমাজের সঠিক কাজে লাগানো, যাতে সুস্থ সমাজ গড়ে ওঠে। যেখানে সেখানে বীজ ফেললেই তো ফসল হয় না, সেটা একটা বোকাতেও বোঝে।
 তাই আগে দরকার মানুষ তৈরি, বা বীজ ফেলার আগে চাই তৈরি জমি। বাবাজী মহারাজ সেই জমি তৈরির কাজ করছিলেন। তাই বলেছিলেন, সাধুরা আসেন, সাধুদের আসতে হয়, নইলে সমাজে নানা অনিয়ম চলে আসে। সাধুদের কাজ তাদের সাধনা, শিক্ষাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে একটা নতুন সমাজ গড়া। 
 বাবাজীর কথায় রবীন্দ্রনাথ --- কখন যে দিন ফুরায়ে যাবে…

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad