কর্মযোগের মাধ্যমে বাবাজী মহারাজ আমাদের শেখাতে চেয়েছিলেন, কর্ম বিনা ঈশ্বর লাভ সম্ভব নয়

তারক ঘোষ
অনেকেই প্রশ্ন করতেন, বাবা, আশ্রমও কি বন্ধন নয়? সন্ন্যাসীর তো বন্ধন থাকে না, থাকে না ষড়রিপুর তাড়না, থাকে না বিলাস-ব্যসন। তাহলে? আপনারা যদি শ্রীবাবাজীর জীবনের প্রতিটি কর্মে লক্ষ্য রাখেন, এর উত্তর পেয়ে যাবেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব লোকশিক্ষা দিতে গিয়ে একটা গল্প বলেছিলেন। এক গ্রাম্য রমণী ঢেকিতে পাট দিচ্ছেন, আর এক রমণী গর্ত থেকে ভাঙ্গা চাল বের করে আনছেন হাত দিয়ে। ঢেকির মুগুরটা হাতে পড়ার আগেই তিনি ততপরতার সঙ্গে চাল বের করে মাটির উপরে রাখছেন। এইসময় আচমকাই তার বাচ্চাটি কেঁদে উঠল। তিনি উঠে শিশুটিকে কোলে শুইয়ে বা হাত দিয়ে ধরে দুধ খাওয়াতে লাগলেন, আর অন্য হাত দিয়ে আগের মতোই চাল বের করতে লাগলেন গর্ত থেকে। 
 ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা বল দেকিনি, ওই রমণী একসঙ্গে দুটো কাজ করছে, চাল বের করছে আর ছেলেকে দুধ দিচ্ছে, ওর মনটা কোথায়? সবাই চুপ। 
ঠাকুর হেসে বললেন, ওর মনটা ঢেকির মুষলটার দিকে, ওটা যাতে হাতে পড়ে না যায়, সেদিকেই তার লক্ষ্য।
God helps those who help themselves. মানসিক বল, সব বলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। মানসিক শক্তিই একজন মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যে ব্যক্তি লক্ষ্য ঠিক রেখে হাজার সমস্যাকে এড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার মানসিক বল সঞ্চয় করতে পারেন, সেই জয়ী হয়। অনেকের জ্ঞান থাকে, কিন্তু মানসিক বলশূন্যতার কারণে সারাজীবন কিছু করতে পারে না। হয়তো অনেকেই ভাবেন কিছু একটা করবেন, কিন্তু মানসিক দৃঢ়তার অভাবে করে উঠতে পারেন না। 


বইটি কিনতে চাইলে  8927042594 নম্বরে whatsapp করুন।

মনে রাখতে হবে, অর্থ বাধা হয় না, বাধা হয়, ঐকান্তিকতার অভাব। কর্ম আর ধর্ম, একই সঙ্গে যিনি পালন করতে পারেন, তিনি ধন্য। তাই শ্রীবাবাজী মহারাজ সংসারী মানুষদের সম্পর্কে প্রায়ই বলতেন, তোরা তো বহুমুখী থেকেও ধর্ম পালন করার চেষ্টা করছিস। শ্রীবাবাজী ধর্মের মাধ্যমে কর্ম করার উপদেশ দিতেন। আমাদের জীবনেও সেটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। একহাত ঈশ্বরের পায়ে রেখে, অন্য হাতে সাংসারিক কর্ম করা উচিত। তবে সেই কর্ম হয়ে উঠবে নিষ্কাম কর্ম। 
শ্রীগীতায় এই নিষ্কাম কর্মের কথা বলা হয়েছে। 'মা ফলেষু কদাচনঃ' অর্থাৎ ফলের আশা না রেখে কর্ম করো। কিন্তু, সেটা কী সম্ভব? আমরা তো ফল পাবো বলেই কর্ম করি, ভালোভাবে বাঁচবো বলেই চাকরি-ব্যবসা করি। ভালো কাজ পাবো বলেই পড়াশোনা করি, ছেলে মানুষ করি, ভবিষ্যতে ওরা দেখবে বলেই। আত্মীয়দের উপকার করে, পরে তাদের কাছ থেকে সাহায্য না পেলে হাহুতাশ করি, গালমন্দ দিই তাদের, অকৃতজ্ঞ বলি। কষ্ট পাই, ছেলে ভবিষ্যতে দেখলো না বলে।
এ সব কেন জানেন, আমরা ফলের কথা ভেবে কর্ম করি বলে। যদি, আপনি মনে করেন, আপনি কর্ম করছেন, ঈশ্বরের সেবা করছেন – এই ভেবে, তাহলে সেই কর্ম কোনো ফলের আশা করবে না। শ্রীবাবাজী বলতেন, সব কাজই কর, তার সেবা করছিস মনে করে। 
যদি প্রতিটি কাজকেই পূজা মনে করিস, তাহলে কর্মে ক্লান্তি আসবে না, কাজ হবে নির্ভুল আর খারাপ কাজ করার আগে মনে পড়ে যাবে, তুই নিজের জন্য করছিস না, ঈশ্বরের জন্য করছিস। তোর মনে ভয় আসবে, খারাপ কিছু করতে পারবি না।
 শ্রীবাবাজী ছিলেন সন্ন্যাসী, তিনি ছিলেন কর্মযোগী, তিনি ছিলেন, জ্ঞানের ভান্ডার, তিনি ছিলেন বিজ্ঞান-মনস্ক এক আধুনিক তাপস। তার আগে আমরা যে বিশেষণই ব্যবহার করি না কেন, তাকে প্রকাশ করার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। তিনি অনন্ত। তিনি ছিলেন আন্তরিক। মানুষের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে,মানুষ এতো ভালোবাসা পেতে পারে না। 
তিনি তাই মানুষের জন্য করার কথা ভেবেছিলেন, সমাজের কথা ভেবেছিলেন। সন্ন্যাস নেওয়ার পর একজন সন্ন্যাসী তার পূর্বাশ্রমের সব কিছু ভুলে যান। ফেলে আসেন পিতৃদত্ত নাম, পদবী, সংসার জীবনের বন্ধন। কিন্তু আশ্রমিক জীবনে এসে তিনি লাভ করেন আর এক নাম, আর এক পদবী – আর এক ‘বন্ধন’। 
অনেকেই প্রশ্ন করতেন, বাবা, আশ্রমও কি বন্ধন নয়? সন্ন্যাসীর তো বন্ধন থাকে না, থাকে না ষড়রিপুর তাড়না, থাকে না বিলাস-ব্যসন। তাহলে? আপনারা যদি শ্রীবাবাজীর জীবনের প্রতিটি কর্মে লক্ষ্য রাখেন, এর উত্তর পেয়ে যাবেন।
শ্রীবাবাজী কোনদিন এই সংসারকেও অস্বীকার করেন নি, আবার ঈশ্বরকেও নয়। তার কাছে, জগত সত্য, ঈশ্বর সত্য। তিনি সেটা বিশ্বাস করতেন বলেন তার থিসিসে এই কথা গুলিই তুলে ধরেছিলেন। এবার, আর একবার তাকান তার কর্মের দিকে। সংসারে আমরা কর্ম করি নিজের বা পরিবারের স্বার্থে। অর্থ একটু বেশি থাকলে আর মনটা একটু প্রশস্ত থাকলে আত্মীয়দের কথাও ভাবি, বা তাদের জন্য কিছু করার কথা ভাবি।
 কিন্তু, এই সবকিছু করার পিছনে নিজের স্বার্থ জড়িয়ে থাকে, কামনা থাকে। এই কর্ম নিষ্কাম নয়। কিন্তু শ্রীবাবাজী যা করেছেন, তা দশের স্বার্থে। আশ্রম, ভক্তদের জন্য, গ্রামের রাস্তা, সব মানুষের জন্য, গ্রামে বিদ্যুত, বাড়িতে বাড়িতে শৌচাগার – মানুষের জন্য, বিদ্যালয়, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। কাঠ-পুতুল শিল্পীদের লড়াকু জীবনের সঙ্গে থেকেছেন, আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, মিষ্টান্ন-শিল্পীদের পাশে থেকেছেন – কেন? নিজের স্বার্থে, না কি দশের স্বার্থে? 
তিনি কি কর্মের ‘ফল’ এর আশা করেছেন? করেন নি।
 দানের প্রতিদান আশা করেছিলেন? করেন নি। 
 ছোট ছোট ছেলেদের মনকে পবিত্র করার জন্য গীতা পাঠ, মানুষকে জ্ঞান দিয়ে সঠি পথে আনার জন্য প্রবচন, জ্ঞানী মানুষদের জন্য গ্রন্থ রচনা – এ সবই তার নিষ্কাম কর্মের উদাহরণ। তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ কর্মযোগী। 
আর এই কর্মযোগের মাধ্যমে আমাদের শেখাতে চেয়েছিলেন, কর্ম বিনা ঈশ্বর লাভ সম্ভব নয়। আর করতে হবে সৎ কর্ম, যে কর্ম শুধু ঈশ্বরকে নয়, নিজেকেও পরিতৃপ্তি দেয়, যে কর্মের জন্য আপনি দিনের শেষে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন – সেই কর্ম।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad