রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা শ্রীবাবাজী মহারাজকে নতুন জ্ঞানভান্ডারের সামনে দাঁড় করিয়েছিল



 

বাবাজী বুঝেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ফুরিয়ে যায়নি তার সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতা। তিনি বুঝেছিলেন, এই কলিযুগের ভয়ঙ্কর পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ আজ ভীষণ প্রাসঙ্গিক। 

 

তারক ঘোষ

 

 রূপনারায়ণের কূলে’ কবিতায়… যেখানে বিশ্বকবি বলছেন – ‘‘রূপ-নারায়ণের কূলে জেগে উঠিলাম; জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়।

 কিংবা আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন----কবির চেতনায় ধরা পড়েছিল – “এ জগৎ স্বপ্ন নয়।

 ঈশ্বরও সত্য, আর জগৎও সত্য। কোনটাকেই অস্বীকার করে সেই চরম সত্যে পৌঁছানো যায় না, যে সত্যেরঅপর নাম ঈশ্বর। সত্য কঠিন, সেই কঠিন সত্যকে কবি ভালোবেসেছেন, কেননা, তিনি বুঝেছেন সত্য কাউকে বঞ্চনা করে না।  কবিগুরুর মতো বাবাজীও বুঝেছিলেন সেই চরম সত্যকে। তিনিও আজীবন দুঃখের তপস্যাই করে গেছেন আর মৃত্যু দিয়ে তার সব দেনা শোধ করে গেছেন।

 


 শ্রীবাবাজী ছিলেন সেই সত্যের পূজারী, যে সত্য বারে বারে তাকে আঘাত করেছে। ক্ষত-বিক্ষত করেছে তার অন্তর। মিথ্যা অপবাদ চেপেছে তার মাথায়, কিন্তু কখনো সত্যের পথ থেকে তিনি সরে আসেন নি। তিনি চলে যাবার আগে তাই যেন বলে গেছেন –“আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো।

বাবাজী বুঝেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ফুরিয়ে যায়নি তার সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতা। তিনি বুঝেছিলেন, এই কলিযুগের ভয়ঙ্কর পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ আজ ভীষণ প্রাসঙ্গিক। 

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা শ্রীবাবাজী মহারাজকে নতুন জ্ঞানভান্ডারের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। তাই পুরাণ হোক বা মহাভারত হোক, তার মুখে উঠে আসতো রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা। কবির দ্বর্থবোধক কবিতার অর্থ বাবাজী বুঝেছিলেন, বুঝেছিলেন কবিগুরু ছিলেন এক মহাসাধক। ঈশ্বরের এক অসামান্য দান। 

তাই বাবাজী বারবার বলতেন, “আমাদের সৌভাগ্য আমরা রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি। 

 শ্রীবাবাজী একটি প্রবন্ধে লিখছেন (মার্জনা করবেন, আমি তার লেখাটা সাধু থেকে চলিত বাংলায় করেছি, সকলের বোঝার জন্য) –“নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের এই দাস্য ভাবের সাধন রবীন্দ্র রচনায় বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের রাজানাটকটির মধ্যে কিভাবে শ্রীভগবানের দাস হওয়া যায়, তা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। 




 বাবাজী বলছেন – “ভারতের আধ্যাত্মিকতা এখানে একটি সুষ্ঠ, সংহত কিন্তু চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। ভক্তি কাকে বলে, শরণাগতি কি জিনিষ, অভিমানের স্বরূপ কি, এবং কীভাবে তাকে জয় করতে হয়, তা খুব ভালোভাবে শেখা যায় এই রাজানাটকের মাধ্যমে। 

তিনি রবীন্দ্রনাথের ভাষা তুলে ধরে বলেছেন –“দুঃখের বেশে এসেছ বলে তোমায় নাহি ডরাব হে/যেথায় ব্যথা সেথায় আরও নিবিড় করিয়া ধরিব হে” –যে সর্বনাশের পরও আশা ছাড়ে না তার কাছে তিনি আসেন, ভক্তকে আলোর জগতে এনে একাত্ম করে নেন।

আমাদের গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে দেখতে পেরেছেন, আমরা পারিনি। যদি তা পারতাম, তাহলে জাগতিক দুঃখে আমরা কাতর হতাম না। জাগতিক দুঃখ কবিগুরুকে যেমন তার সৃষ্টি থেকে বিরত করতে পারেনি, তেমনি পারেনি বাবাজী মহারাজকে তার লক্ষ্য পথ থেকে সরাতে। 

শ্রীবাবাজী মুক্ত হয়েও বন্ধনের মাঝেই খুঁজেছিলেন মহানন্দময় মুক্তিকে। 

কবিগুরুর ভাষায় বলা যায় – “প্রদীপের মতো/সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়/জ্বালায়ে তুলিবে আলো, তোমারি শিখায়/তোমারি-মাঝে। 

বাবাজী মহারাজ ভালোবাসতেন গান শুনতে। গান জানা ভক্ত এলেই, সেদিন আর পাঠ হতো না। হতো গান। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর তখন ঘুরে বেড়াতো তপোবন আশ্রমের গন্ডীর মধ্যে।




 তিনি একমনে চোখ বন্ধ করে ডুবে যেতেন কোন এক অমৃতলোকে। তার চেতনা বিলীন হতো সুরের সমুদ্রে। কতোবার তার এই ভাব দেখেছি। গান যেন তার জীবনের ক্লান্তি হরণকারী। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad