তারক ঘোষ
মন মুখ আর বাহ্যিক আচরণের মধ্যে মিল না থাকলে, সেই ব্যক্তির উপর বিশ্বাস জন্মায় না। একজন
লেখক, যিনি তার লেখায় মানবতার কথা বলেন, প্রকৃতিকে ভালোবাসার কথা বলেন, সেই লেখক যদি ব্যক্তিগত জীবনে ঠিক এর উলটো হন, তাহলে তার সম্পর্কে তার পাঠকদের ভাবনাটাও
বদলায়। প্রশ্ন ওঠে,
তিনি নিজে যা লেখেন, তা কি বিশ্বাস করেন না?
বহু সাধু আছেন, যারা মুখে ‘ত্যাগ’ এর কথা বলেন, অথচ নিজেরা ভোগের বাসনায় লিপ্ত। তার শিষ্যরা যদি একেবারে অন্ধ না হন, তাহলে তারা ঠিকই বুঝবেন, গুরুদেব মুখে বলেন এক, কাজে করেন অন্য। অথবা, ত্যাগ শুধু শিষ্যদের জন্য, গুরুর জন্য নয়। আমাদের বাবাজী মহারাজ ছিলেন জন্ম সন্ন্যাসী, পরোপকারী, জ্ঞানী, জ্ঞানপিপাসু ও সমাজ-বিজ্ঞানী। তাই অন্য সাধকদের সঙ্গে তার পার্থক্য হাজার যোজন। তিনি গুরুদেবদের কী রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে নানা কথা বলেছেন।
গুরু কেমন হবে, কে গুরু? বাবাজী মহারাজ বহুবার
রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ নাটকের
প্রসঙ্গ তুলে এই নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন –
“আমরা সহজে গুরু হয়ে
যাচ্ছি। ফলে আমাদের কথার গুরুত্ব কমছে। এই প্রসঙ্গে তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা
তুলে বলেছিলেন – শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, ‘সাধু হল বারুদ ভরা গুলি আর গৃহস্থ হল ফাঁকা
গুলি।‘ কাজেই
সাধু যদি আধ্যাত্মিকতায় ধনী না হয়, তাহলে তো সমাজ পরিবর্তন করতে পারবেন না। আমরা
যেন নিজেদের যোগ্য করে তুলেই আপনাদের সামনে আসতে পারি।‘
একবার সন্ধ্যায় বাবাজীর কাছে বসে আছি। দেখলাম ওই গ্রামের এক
বয়স্ক ভদ্রলোক এলেন। বিশেষ কারণে, আমি তার নাম লিখছি না। তার মেয়ের খুব অসুখ।
বাবাকে তিনি যেইমাত্র সেকথা নিবেদন করলেন, বাবাজী রেগে গিয়ে বললেন, "তোকে কতবার বলবো, ডাক্তার দেখা, দক্ষিণভারতে নিয়ে যা। তুই
কোন কথাই শুনছিস না। মেয়েটাকে যদি এভাবে রেখে দিস, ও মরে যাবে যে! যা, দরকার হয়, এখানকার সবাই তোকে সাহায্য
করবে। তুই এখনি ওকে নিয়ে যা। আর আমি ভগবানের কাছে নিবেদন করব।"
তারপর দেখলাম, উনি কাউকে বললেন কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
বাবা বিশ্বাস করতেন – জগত সত্য, ঈশ্বরও সত্য। তাই জাগতিক কাজকর্মকে তিনি যেমন
গুরুত্ব দিতেন, তেমনই
বিজ্ঞানসম্মত ভাবনা তার মধ্যে সর্বদা ক্রিয়াশীল থাকত। মেয়েটি এখন সুস্থ। বাবাজীর
দেহান্তের পর তার বাড়িতে আমি আর আমার স্ত্রী গিয়েছিলাম। ভালোই আছে।
বাবাজী জানতেন, কখন, কোথায়, কী করা উচিত। সেই শিক্ষাই বারবার
আমাদের তিনি দিয়ে গেছেন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে।
একবার এক বৃদ্ধা এসে বাবাকে
প্রণাম করে বসলেন, বাবার সামনের লাল
মেঝেতে। তারপর আঁচলের গিঁট খোলার চেষ্টা করলেন। তাকিয়ে দেখলাম, বহু কষ্টে সেই গিঁট খুললেন, কেননা তিনি এতো বেশি গিঁট
দিয়েছিলেন যে, খোলা বেশ কঠিন। অবাক
হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, কী এমন অমূল্য বস্তু
ওখানে আছে, সেটা দেখার জন্য।
দেখলাম, উনি গিঁট খুলে বহুবার ভাঁজ করা
একটা ১০০ টাকার নোট বের করলেন। তারপর, বাবার পায়ের কাছে গিয়ে সযত্নে ওই টাকাটার ভাঁজ খুলে রাখলেন। বাবা
দেখলাম, খুব রেগে গেছেন। বললেন, এসব কেন এনেছেন? উনি বললেন, বাবা, এটা তোমাকে নিতেই হবে। নাহলে, আমি শান্তি পাব না। বাবা আর কিছু
বললেন না।
ওই বৃদ্ধা চলে যাওয়ার পর একজনকে
ডেকে বললেন, "ওই টাকাটা ওকে ফেরত দিস, বহু কষ্ট করে এনেছে, চুরি যাওয়ার ভয়ে কীভাবে গিঁট দিয়ে রেখেছিল। উনি যেন কষ্ট না পান, এমনভাবে টাকাটা ওকে দিয়ে দিস।
"
যারা মনে করেন, অমুক ব্যক্তির মুখ-দর্শন করাতেই
তার বিপদ হল। অন্যদিকে, সেই ‘অমুক’ ব্যক্তিটিও ভাবতে
পারেন, ‘তমুক’ ব্যক্তির মুখোমুখী হওয়াতেই তার কার্যসিদ্ধি হল না।এটা একটা
অন্ধ-বিশ্বাস। এই প্রসঙ্গে স্বামী জানকীদাসজীর প্রসঙ্গ টেনে বাবাজী বলতেন – বাবা বলতেন, ‘কারো মুখ
দেখা পাপ, এই কথাটা কুসংষ্কার। এটা
সামাজিক অন্যায়।‘
বাবাজী বলতেন, সমাজ থেকে এই দুষ্ট ক্ষতকে মুছে ফেলতে হবে, নইলে আসল ধর্মটাই চাপা পড়ে যাবে
আর আমরা মেতে থাকব অন্ধ-বিশ্বাস নিয়ে। বিশ্বাস মানুষের উন্নতি করে যতটা, অন্ধ-বিশ্বাস আর কুসংষ্কার ক্ষতি
করে তার চেয়েও বেশি।‘
বাবাজী বলতেন, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে ভোগ, তার শুরু ও শেষ আছে, তাই এই ইন্দ্রিয়ভোগের দ্বারা
মানুষের জীবনে কখনোই শান্তি আসতে পারে না। ভোগ করতে করতে, একটা সময় আসবে হতাশা। আর এই হতাশা
থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজতেই তখন মানুষকে ফিরতে হবে সেই সুপ্রাচীন পথে, যে পথ আমাদের নিয়ে যাবে
পরমশান্তির দিকে।
জপ, ধ্যান ধর্মীয় ব্যাপার শুধু নয় এর মধ্যে আছে বিজ্ঞান। আর জপ ও ধ্যানের
মাধ্যমে মানুষ খুঁজে পাবে জীবনের পরম শান্তি। তিনি একইসঙ্গে আর একটি কথা বলতেন। তা
হল – পরের জন্য বাঁচা, নিজেকে তার জন্য প্রস্তুত করা আর
নিঃষ্কাম কর্ম করে যাওয়া।
তিনি বলতেন, নেতাজী, স্বামীজী, এপিজে আব্দুল কালাম, বালগঙ্গাধর তিলকের জীবন ও বাণী
মানুষকে পথ দেখাতে পারে। তারা যে আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, আমরা কোথাও না কোথাও সেই আদর্শ
থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আর এই দূরে সরতে সরতে আমরা চলে যাচ্ছি ঈশ্বরের কাছ থেকে, মুক্তি থেকে অনেক দূরে। ওই সমস্ত
মহামানবরা আমাদের দিয়ে গেছেন প্রকৃত ভারতীয় আদর্শ, কুসংষ্কারবিরোধীতা আর সংযমের শিক্ষা।
তিনি মিডিয়ার ভূমিকা তুলে বলেছিলেন – সমাজ গঠনে যুবসমাজ আর মিডিয়াকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন ভারত গড়তে হলে দূর করতে হবে অন্ধ-ধর্মীয় বিশ্বাস। মিডিয়ার কাজ শুধু অর্থ উপার্জন নয়, সমাজ গঠন করাও তাদের একটা কাজ।