উপরে লেখা শিরোনাম আমার বিশ্বাসের প্রতিফলন। কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়।
তারক ঘোষ
অবতার-এর অর্থ হচ্ছে উপর থেকে নিচে নামা বা
অবতরণ করা। ধর্মকে যিনি রক্ষা করেন,
ধর্ম তাকে রক্ষা করে - ‘ধর্মো
রক্ষতি রক্ষিতঃ'। তবে মনুষ্যসমাজে মাঝে মাঝে ধর্মের প্রতি
অবজ্ঞা, অবহেলা দেখা দেয়। ধার্মিকদের জীবনে নেমে আসে
নিপীড়ন-নির্যাতন। নানাধরণের সামাজিক অবক্ষয়,
অত্যাচার-অনাচার
সমাজজীবনকে কলুষিত করে তোলে। আর এরকম অবস্থায় পথভ্রষ্ট মানুষকে সুপথে বা ধর্মের
দিকে ফিরিয়ে আনতে ভগবান যুগে যুগে যে সকল মহামানবদের প্রেরণ করেন তাকে অবতার বলে।
অবতারের উদ্দেশ্য খারাপ মানুষদের সংশোধন,
ভালো মানুষদের রক্ষা করা, দুঃখ-কষ্ট
থেকে মুক্ত করা এবং ধর্ম সংস্থাপন করা।
যেমন এসেছিলেন মহাপ্রভু। কৃষ্ণ নামে তিনি
শুধু সমাজ জীবনকে সঞ্জীবিত করেন নি,
সামাজিক ও ধর্মীয় অবক্ষয়কে
রুখতে চেয়েছিলেন। তাকেও চলে যেতে হয়েছিল
কাজ অসমাপ্ত রেখেই। এই তালিকায় রয়েছে অনেক মহাপুরুষদের নাম। মধ্যযুগে চৈতন্যদেব আর
আধুনিক যুগে শ্রী রামকৃষ্ণদেব অবতার বলে অবিহিত।
ভক্তরা শ্রীরামকৃষ্ণকে অবতার বরিষ্ঠ বলেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে বিজয়কৃষ্ণ। বিজয়কৃষ্ণ
ঢাকায় আশ্রম স্থাপন করলেও মাঝে মাঝেই তিনি কোলকাতা যেতেন। একবার স্ত্রীকে নিয়ে
তিনি বৃন্দাবনে যান। সেখানে কলেরা রোগে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তারপর ১৩০৪ সালের
(১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) ফাল্গুন মাসে বিজয়কৃষ্ণ শ্রীক্ষেত্র পুরী চলে যান। সেখানে অতি
অল্প সময়েই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। ওড়িশাতেও তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এতে
ঈর্ষান্বিত হয়ে স্থানীয় ধর্মব্যবসায়ীরা একদিন তাকে বিষ মিশ্রিত লাড্ডু খেতে
দেয়। তাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৩০৬ সালের (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) ২২এ জ্যৈষ্ঠ
রবিবার ইহলোক ত্যাগ করেন। আর এক জনের কথা না বললেই নয়। তিনি আমাদের বাবাজী মহারাজ। তাকেও চলে যেতে হয়েছে তার সমাজ ও ধর্ম সংষ্কারের কাজকে অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে
রেখে।
অবতার দুই রকমের - পূর্ণাবতার ও অংশাবতার। ভগবান যখন পূর্ণরূপে অবতরণ করেন, তখন তাকে বলা হয় পূর্ণাবতার। ভগবানের সমস্ত শক্তি ও গুণ পূর্ণাবতারের মধ্যে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবানের পূর্ণাবতার। কারণ ভগবানের সমস্ত ঐশ্বর্য তার মধ্যে ছিল।
ভগবানের অপূর্ণাঙ্গের অবতারকে বলা হয়
অংশাবতার। অংশাবতারে ভগবানের সমস্ত শক্তি ও গুণ থাকে না। অংশাবতার অনেক। তার মধ্যে
দশটি প্রধান, যেমন- মৎস্য,
কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি। এরা বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত
হয়ে জগতের কল্যাণ সাধন করেছেন।
বাবাজী মহারাজের জীবন ও ধর্মীয় দর্শন আর
পাঁচটা সন্ন্যাসীর মতো ছিল না। তার প্রতিটি কাজ, তার
ভাবনা, দর্শন ও গবেষণার বিষয়কে যদি কেউ ভালোভাবে লক্ষ্য বা
পর্যালোচনা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন, তার
একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল ধরাধামে নেমে আসার। আর তিনি আসবেন, একথা
জানতেন শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ। তাই তিনি চলে এসেছিলেন মেমারীর কাছে বড়র গ্রামে। অপেক্ষা
করছিলেন তার ভাবী সন্ন্যাসী শিষ্যের জন্য। আর যেদিন সেই গুরু-শিষ্যের মিলন হল, সেদিনই
রচিত হল এক নতুন ধর্মীয় নবজাগরণ। দাদাজী মহারাজ তার এই সাধু শিষ্যকে দিয়ে
গিয়েছিলেন বিশেষ কিছু উপদেশ যা সাধারণ সাধু-সন্ন্যাসীরা তাদের পরবর্তী শিষ্যদের
দেন না। এর প্রথম উপদেশ – শিষ্যদের সর্ব বিপদ থেকে
রক্ষা করা। দ্বিতীয় উপদেশ – সামাজিক সংষ্কার। তার মনের
মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন কুসংষ্কারমুক্ত এক সমাজের চেতনা।
শ্রীচৈতন্যদেব নিজে কুসংস্কার মানতেন না। আমাদের বাবাজী মহারাজ এই কুসংষ্কারের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। সেই কুসংষ্কার ধর্মের মধ্যেই থাকুক, আর সামাজিক ক্ষেত্রেই থাকুক, তিনি এর প্রতিবাদ করেছেন বারে বারে। সমালোচনা করেছেন, কুম্ভে আগত একশ্রেণির ‘সাধু’দের আচরণের। বাবাজী মহারাজের এ হেন আচরণ সবাই ভালো মনে যে মেনে নিয়েছিলেন, তা কিন্তু নয়। তবু তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন এই সমাজকে রক্ষা করতে। এক অপরূপ ভাবী প্রজন্ম উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে।
আগেই বলেছি, বাবাজীর জীবন আর স্বপ্ন অন্য সাধুদের মতো ছিল না। এখন তো অনেকেই উপযুক্তভাবে শিক্ষিত না হয়েই ‘সাধু’ হয়ে জ্ঞান বিতরণ করেন। নিজে ভোগে লিপ্ত থেকে অন্যদের কাছে ভোগের ক্ষতিকর দিক কী – তা অনায়াসে আলোচনা করেন। বাবাজী এসব থেকে সহস্র যোজন দূরে ছিলেন। জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণ কামনায়, শিক্ষার প্রসারে, কুসংষ্কারের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে সেখান থেকে সাধারণ মানুষকে সরে আসতে উপদেশ দিয়েছেন। আর এখান থেকেই আমার মনে হয় বাবাজী এসেছিলেন এক অংশাবতাররূপে। চলবে…