শ্রীগুরু ও শিষ্যের মধ্যে সংযোগকারী সেতু হল জপ, আর জপ-ধ্যান বিশ্বপিতার সঙ্গে সংযোগ ঘটায়

 


এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য আত্মসমালোচনা।

তারক ঘোষ

 

আমি আগেই বলেছি, সবাই সদগুরু হতে পারেন না। শ্রীভগবান যদি তাদের সদগুরু হওয়ার লক্ষণ না দিয়ে পাঠান, তিনি হাজার চেষ্টাতেও সদগুরু হতে পারবেন না। শাস্ত্রের বিধান সেটাই। সদগুরুরা মৃতুঞ্জয়ী হন। বাহ্যিকভাবে তাদের দেহের বিনাশ হয় ঠিকই, কিন্তু তারা হয়ে ওঠেন আরো শক্তিশালী।

আবার সব শিষ্যরাই গুরুসেবা করতে পারেন না, কারণ, সদগুরুরা তাদের সব শিষ্যকে দিয়ে সব কাজ করান না। তিনি যন্ত্রী, তিনিই ঠিক করে দেন, কোন যন্ত্র বাজবে, বা কীভাবে বাজবে।  যাকে দিয়ে যা করাবার তিনি করাবেনই, কোনো বাধাই সেখানে টিকবে না। কোনো গুরুদেবই আত্মপ্রচার চান না। তারা নিজেদের প্রচার নিজেরা করেন না। তারা প্রচার করেন নিজ নিজ শ্রীগুরুর দর্শন ও আদর্শের। মানুষের মাঝে গিয়ে, গ্রন্থ লিখে তারা শিষ্য তথা ভক্ত তথা সাধারণ মানুষজনকে সঠিক পথের নিশানা দিয়ে যান।

,

আমাদের গুরুভক্তির অনেকটাই লোকদেখানো। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য। আমরা কতজন নিয়মিত জপ করি? আমরা কতজন অতিথিকে নারায়ণ জ্ঞান করি? আমরা কতজন নিজেদের স্বার্থ ফেলে অন্যের সাহায্যে লাফ দিই? না, আমি জানি, আমরা পারি না। কারণ, নিজের স্বার্থে আমরা গুরুর কাছে যেতাম। সবাই নয়। বহু প্রকৃত শিষ্য আছেন, যারা সবার অজান্তে শ্রীগুরুর পথ ও মতকে মেনে জীবন পথে চলেন। কিন্তু, বেশিরভাগ মানুষই শ্রীগুরুর কাছে যেতেন, তার নিজের সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে। সেই সমস্যা মিটে গেলে ভালো, আর না মিটলে জপ উঠলো মাথায়। লোকদেখানো কিছু কথা, কিছু ধূপ-ধুনো। এটাই গুরুদেবের পাওনা হয় সেই সব শিষ্যের কাছ থেকে।

কিন্তু, শ্রীগুরু এসব চান না। তারা চান – শিষ্যরা ভুল পথ ত্যাগ করে সঠিক পথে চলুক। তিনি শিষ্যদের হাসিমুখ দেখতে চান। শিষ্যের হাজার অগ্রাহ্যভাবকেও তারা উপেক্ষা করেন।  কারণ, যিনি একবার সদগুরুর কাছে আশ্রয় পেয়েছেন, গুরু তাকে ছাড়েন না। শিষ্য ছেড়ে যায়। তা সত্বেও গুরু তাকে আগলে রাখেন। তার বিপদ হতে দেন না। কিন্তু, তিনি সব শিষ্যকে আঘাত দেন না, আঘাত তাকেই দেন, যাকে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজের কাছে টানতে চান। একজন ভালো ছাত্রকে শিক্ষক বারংবার পরীক্ষা নেন, কিন্তু, খারাপ ছাত্রকে যখন চেষ্টা করেও পালটানো যায় না, তাকে তার পথেই ছেড়ে দেন। সদগুরুও তেমনই।

শ্রীরামদাসজী কাঠিয়া মহারাজ বলতেন – সদগুরু ছায়ার মতো থেকে তার আশ্রিত শিষ্যকে রক্ষা করেন। আর বলতেন – বড়ি ভাগ সে সদগুরু মিলতা। সত্যিই তাই।  

এখন দেখা যাক জপ কী?


অযাচকের ‘জপ’ নিবন্ধ থেকে জানতে পারি -

জপ হল প্রথমত একটি স্বেচ্ছাকৃত স্পন্দন। মনকে একটি সুনির্দ্দিষ্ট নিয়মে স্পন্দিত করার নাম জপ। এই স্পন্দন বাইরের কোনও স্পন্দনের তালে তালে হতে পারে অথবা নিজ ইচ্ছাকৃত চেষ্টানুসারেও ঘটতে পারে। স্পন্দনই ক্রমশ রূপ ধারণ করে। অর্থাৎ স্পন্দন থেকে মন্ত্র এবং রূপ এই উভয়েরই আবির্ভাব। মন্ত্রই ক্রমশ রূপ পরিগ্রহ করে। জপের গভীরতা অনুযায়ী মূর্তি দর্শন হতে থাকে। এই মূর্তি দর্শন সাধারণত স্বল্পকালের জন্য দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। কখনো কখনো এই  মূর্তি একটু বেশিক্ষন স্থায়ী হয়। এর পরে আসে জ্যোতিঃ।  এই জ্যোতি আর কিছু নয়, পরলোকগত মহাত্মাদের দেহ জ্যোতিঃ মাত্র।


এর পর এইসব মহাত্মাদের জ্যোতি ধীরে ধীরে ঘনীভূত আকার নেয়
, এবং সাধক তখন মূর্তি দর্শন করতে থাকেন। এই মূর্তি কখনো ভেসে উঠেই আবার মিলিয়ে যায়। কখনো দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। এর পর  কিছুদিনের মধ্যেই এই মূর্তির সাথে কখোপকথন শুরু হতে পারে।  অতি সাধারণভাবে বলা যায়, কোন মন্ত্রের পুনঃ পুনঃ আবৃত্তির নাম জপ। আর জপের লক্ষ্য হল বিশ্বের মূলীভূত স্পন্দনের সঙ্গে নিজের অভিন্নতা প্রতিষ্ঠা।

জপ মানে কূপমণ্ডূকতার বা ডোবার  সঙ্কীর্ণতা নয়। ছোট দিয়ে সুরু হয় হয় জপ, কিন্তু ক্রমশ মহাসাগর মহাকাশ মহাকাল ও মহাবিশ্ব মাঝে ছড়িয়ে পড়াই হল জপসাধনার আসল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। জপের মধ্য দিয়ে আমরা শ্রীগুরু ও পরমেশ্বরের সঙ্গে অভিন্নতা প্রাপ্ত হইনিজের অস্তিত্বের পরিপূর্ণ বিলোপ-বিস্মরণ ঘটে।

বাবাজী বলতেন, জপ ছাড়িস না। জপের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সব। নিয়মিত জপ করে যা, নিজেই বুঝতে পারবি। শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ বলতেন – জপের ছোট্ট মন্ত্রের মধ্যেই সব থাকে। নিষ্ঠা সহ জপ করতে পারলে এই ছোট্ট মন্ত্র থেকেই বিশ্বব্রম্ভাণ্ডব্যাপী শ্রীভগবান প্রকাশিত হন।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad