শিষ্যের পাপের ভার বইতে গিয়েই সদগুরুকে অসময়ে দেহ ছেড়ে চলে যেতে হয়, বাবাজী মহারাজ তাই শিষ্যদের পাপের পথ ত্যাগ করতে বলেছিলেন

 


এই নিবন্ধের বাবাজী মহারাজের ছবিগুলি ৩-৪ জন ভক্তের দেওয়া। তারা এই নিবন্ধকারের ডাকে সাড়া দিয়ে ছবিগুলি পাঠিয়েছেন। তাদের প্রণাম জানাই। 

বাবাজী মহারাজ ‘গুরুলাভ’ প্রবন্ধে লিখছেন –“গুরু শিষ্যকে আত্মদান করেন। নিজে মরিয়া শিষ্যকে বাঁচান।“

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন – “তোর দোরে স্বয়ং নারায়ণ কাঙালবেশে এসে অনাহারে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে রয়েছেন, তাকে কিছু না দিয়ে খালি নিজের ও নিজের স্ত্রী-পুত্রদেরই উদর নানাপ্রকার চর্ব্য-চুষ্য দিয়ে পূর্তি করাসে তো পশুর কাজ। ত্যাগই হচ্ছে আসল কথাত্যাগী না হলে কেউ পরের জন্য ষোল আনা প্রাণ দিয়ে কাজ করতে পারে না।

তারক ঘোষ


গুরুর প্রতি আন্তরিক ভক্তির এখন খুব অভাব। চারিদিকে শুধু দেখানো ভক্তির তাণ্ডব। গুরুর প্রতি কর্তব্য, তার কথা শুনে চলা – এসব অতীত। এখন শুধু কোনরকমে দায়সারা ভক্তি। আর মাঝে মাঝে ধনী শিষ্যদের আলোঝলমলে প্যান্ডেলে গুরুভক্তির নামে ডিজে বাজিয়ে উদ্দামতা। এটাই কলিযুগের গুরুপ্রণামী।

 

সন্তান খারাপ হলে, খারাপ কাজ করলে বাবা-মাকে তার দায় নিতেই হয়। সন্তানের সেই পাপকর্মে তাদের কোনো ভূমিকা না থাকলেও সমাজ তাদের ছেড়ে কথা বলে না, পুলিশও অপরাধী পুত্র বা কন্যার জন্য বাবা-মাকে নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করে থাকে। এমন ঘটনাও ঘটেছে, পুত্র-কন্যার পাপের বোঝা বইতে না পেরে বাবা বা মাকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে হয়েছে। তাই কোনো পিতা-মাতাই চান না, তাদের সন্তান কোনো পাপ কর্ম করুক।

ঠিক তেমনই আমাদের শ্রীগুরু। তার কাছে সব শিষ্য-শিষ্যাই ছিল সন্তানের মতো। খারাপ সন্তানকেও তিনি ত্যাগ করতে পারেন নি। কিন্তু, তাদের পাপ শ্রীগুরুকে স্পর্শ করে, তার মন ও দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে। বারবার তিনি তাই সকলকে বলতেন, পাপের বাপ কে জানিস? লোভ। লোভ করিস না, লোভ এলেই পাপ আসবে। সব কেড়ে নিয়ে চলে যাবে। এ নিয়ে তিনি আমাদের শিক্ষার জন্য নানাধরণের গল্প বলতেন, যাতে আমাদের জ্ঞানচক্ষু খোলে। কিন্তু, দূর্ভাগ্য আমাদের। তাই জ্ঞানচক্ষু খোলে নি। ফলে, আমাদের পাপের বোঝা বইতে গিয়ে তাকেই চলে যেতে হয়েছে। আমরা মনে রাখি না, গুরু নির্দেশ মেনে জীবন-যাপনই হল প্রকৃত গুরুসেবা। তাই তার নির্দেশ না মেনে আমরা যথেচ্চাচার করি, আর আমাদের পাপ নেন আমাদের গুরুদেব।

এই ব্যাখ্যা আমার নয়। ভারতীয় সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, সদগুরু শিষ্যের সব ভার নেন। শিষ্য পাপ করে, আর সেই পাপ গুরুকে স্পর্শ করে। বাবাজী মহারাজ বলছেন – “গুরু শিষ্যকে আত্মদান করেন। নিজে মরিয়া শিষ্যকে বাঁচান। নিজের সুখ তিনি চান না। শিষ্যের যা কিছু মলিনতা, যতকিছু সন্তাপ, যতকিছু পাপ নিজে গ্রহণ করে শিষ্যকে কৃতার্থ করেন।“

 আমরা আজ কোন পথে চলেছি ভাবলে মাঝে মাঝে লজ্জা হয়। বাবার দেওয়া মন্ত্র অনেকেই আজ জপ করিনা। বাবার আদর্শ নিয়ে মাথা ঘামাই না। মানুষজনকে তার ভাবাদর্শের কথা বলি না। লোভ ত্যাগ করি না। শুধু, তার ছবিতে ধূপ-ধুনো দেখাই, বাড়ির এখানে সেখানে গুরুদেবের ছবি সাজিয়ে বোঝাতে চাই গুরুভক্তিতে আমি কতটা এগিয়ে। আর যারা ধনী শিষ্য, তার গুরুপূর্ণিমার দিনে রীতিমতো ‘মোচ্ছব’ বসিয়ে দেন। বাপরে বাপ। গুরুভক্তির সেই গদগদ ভাব দেখে, মানুষজন বলে ওঠে – “অমুকবাবুর গুরুর প্রতি কী নিষ্ঠা! দেখলেও চোখে জল আসে। অথচ, বাস্তবে দেখা যায়, তিনি তার অন্যায় পথের উপার্জিত অর্থ ওইভাবে খরচ করে একদিকে সেই অর্থের সাদাকরণ করছেন, অন্যদিকে নিজের ভক্তি জাহির করছেন। একটু খোলা মনে দেখলে চোখে পড়বেই।

বাবাজী মহারাজ বারে বারে এই উদ্দাম ভক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বাবাজী বলছেন –“ছেলের চাকরি না হলে, জিনিষ হারিয়ে গেলে আমাদের মনে খুব দুঃখ হয়, কিন্তু জপ না হলে সেরকম দুঃখ হয় না।“



মনে রাখা উচিত –“সদ্‌গুরুর জীবন হল পূর্ণ দীক্ষার জীবন, অর্থাৎ আত্মদানের জীবন। তারা ব্যষ্টি জীব সন্তানের অহংকাররূপ মলিনতা গ্রহণ করে আপনার শুদ্ধস্বরূপ দান করেন। আত্মদানই হল পূর্ণ দীক্ষা দান। সদ্‌গুরুর কাছে আপন অহংকার সঁপে দিয়ে সদ্‌গুরুর দেওয়া আত্মজ্ঞান গ্রহণ করাই হল সত্যের দীক্ষা গ্রহণ করা। স্ববোধে সতত সব মানাই হল আত্মজ্ঞান লাভ করা বা সত্যদীক্ষা গ্রহণ করা। গুরুর ঋণ শোধ করা যায় না। শুধু পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তার সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়। সন্তান বা শিষ্যের প্রথম অবস্থা হল লঘু। গুরুর সান্নিধ্যে, গুরুসঙ্গ দ্বারা, গুরুর নির্দেশ, আদেশ ও আজ্ঞা পালন করে লঘু শিষ্যে বা সন্তান গুরুবোধ গ্রহণ করে। মানা’-র মাধ্যমেই লঘু গুরুবোধে পরিণত হয়। 



এবার একটা গল্প বলি শুনুন – “একজন মহাপুরুষের এক আশ্রিত ভক্তশিষ্য তার কাছে নাম পেয়ে গুরুমহারাজের সঙ্গেই থাকে এবং খুব নাম জপ করে ও কাজকর্ম করে। সাধারণ লোকে ভাবে ভক্তটি কত উন্নত, গুরুর কাছে কাছে থাকে ও নাম জপ করে। শিষ্যটি সম্বন্ধে প্রায় সকলেরই এই রকম ধারণা। কিন্তু শিষ্যটির মধ্যে ক্রোধ, হিংসা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি সবই রয়েছে। তবু গুরু তাকে কাছে কাছেই রেখেছেন। তার দোষত্রুটিগুলি নামের মাধ্যমে set করিয়ে তার পরে তার আসল দীক্ষা হবে এই জন্য।

Lower nature set হয়ে গেলে তার পরেই ধীরে ধীরে সাধককে উন্নত পর্যায় নিয়ে যাওয়া যায়। তখনই হয় তার আসল দীক্ষা। তখন বাহ্যিক কোন ক্রিয়া অনুষ্ঠানের আর প্রয়োজন হয় না। শিষ্যের সমস্ত প্রকৃতি তখন তদগত হয়, কেন্দ্রাভিমুখী গতি হয়।
শিষ্যের ক্রিয়াকলাপ দেখে সকলেরই খুব উচ্চ ধারণা। হঠাৎ একদিন এক ভক্ত তার একটা অন্যায় আচরণ দেখে গুরুদেবকে নালিশ জানাল।
গুরুদেব বললেন এর আগে তুমিইতো কত প্রশংসা করেছিলে, কিন্তু আজ আবার নিন্দার সুরে কথা বলছ! তোমাদের এ কী রকম বিচারবুদ্ধি? তোমাদের সঙ্গে তার পার্থক্য বিশেষ নেই।
ভক্ত বলল আপনার সঙ্গে থেকে থেকেও তার এরকম দোষ থাকবে কেন?



গুরুদেব তখন বললেন অন্তরের বৃত্তি সবার সমান নয়। কারও কঠোর অনুশাসনের প্রয়োজন হয় আবার কারও বা কম শাসনের প্রয়োজন হয়। লোকে ভাবে সাধুসঙ্গ করলেই বুঝি স্বভাবের শোধন হয়ে যায় পূর্ণ ভাবে। আসলে অন্তরে তার সাধুসঙ্গ হয়নি। বাইরেই শুধু সাধুসঙ্গ হয়েছে

স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন – “কর্মফলে মানুষ মরছে, তাদের দয়া করে কি হবে? দেশটা যে অধঃপাতে গেছে, এই তার চূড়ান্ত প্রমাণ। তোদের হিন্দুধর্মের কর্মবাদ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে দেখলি? মানুষ হয়ে মানুষের জন্যে যাদের প্রাণ না কাঁদে, তাদের কি আবার মানুষ? ত্যাগই হচ্ছে আসল কথাত্যাগী না হলে কেউ পরের জন্য ষোল আনা প্রাণ দিয়ে কাজ করতে পারে না। ত্যাগী সকলকে সমভাবে দেখে, সকলের সেবায় নিযুক্ত হয়। বেদান্তেও পড়েছিস, সকলকে সমানভাবে দেখতে হবে। তবে একটি স্ত্রী ও কয়েকটি ছেলেকে বেশী আপনার বলে ভাববি কেন? তোর দোরে স্বয়ং নারায়ণ কাঙালবেশে এসে অনাহারে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে রয়েছেন, তাকে কিছু না দিয়ে খালি নিজের ও নিজের স্ত্রী-পুত্রদেরই উদর নানাপ্রকার চর্ব্য-চুষ্য দিয়ে পূর্তি করাসে তো পশুর কাজ।

এরপর আগামিকাল

 

 

 

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad