বাবাজী মহারাজ গীতার উল্লেখ করে বললেন, তুই নিজেই তোর বন্ধু, নিজেই তোর শত্রু, তোর ভালো-মন্দ তোর নিজের হাতে

 



তারক ঘোষ

 

ভালোবাসাকথাটিকে নেহাত রোমান্টিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে, একে আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। প্রতিনিয়ত ভালোবাসার অনুশীলন করতে হবে। নিজেকে তো ভালোবাসতে হবেই, পাশাপাশি ভালোবাসতে হবে আশেপাশের প্রতিটি মানুষকে। আর শুধু মানুষই বা কেন, ভালোবাসতে হবে সকল জীবকে। প্রাণ আছে এমন প্রত্যেককে ভালোবাসতে হবে, তাদেরকে ভালো রাখতে হবে।

 

বাবাজী মহারাজ গীতার নানা শ্লোকের উল্লেখ করে মাঝে মাঝে বলতেন – মানুষ নিজেই নিজের বন্ধু, নিজেই নিজের শত্রু আর বিপদ কখনো বাইরে থেকে আসে না, বিপদ আসে ভিতর থেকেই। এই কথাগুলো শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজও বার বার বলেছেন। জানি না  আমরা সবাই ওই বার বার বলা কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝতে পেরেছি কিনা, কিংবা, বুঝে নিজেদের আত্মসমালোচনা করে ভুল পথকে ত্যাগ করে সত্য পথের আশ্রয় নিয়েছি কিনা। যদি, তা না করে থাকি, তাহলে নিজের কষ্টের জন্য  অন্য কাউকে দোষ দিয়ে  লাভ হবে না। আমরা নিজেরাই আমাদের সমস্যার কারণ, আবার আমরা নিজেরাই হতে পা্রি সমাধানের রাস্তা।

আসলে, আমরা জ্ঞানপাপী। সব জেনেও না জানার ভান করি। সব শুনেও নিঃশ্চুপ থাকি। নিজেদের বাহ্যিক সৌন্দর্স্য রক্ষায় যে সময় বা অর্থ ব্যয় করি, তার সিকি ভাগও ব্যয় করি না নিজেদের অন্তরকে শুদ্ধ করার ব্যাপারে। বাইরে বেশভূষা যত চটকদারই হোক না কেন, অন্তরে যদি লালসার বাসা থাকে, তাহলে, আমাদের বাহ্যিক সৌন্দর্য্যই একসময় আমাদের পরিহাস করবে।




আমাদের দিনের বড় একটা অংশ ব্যয় হয়  অর্থ-সম্পদ অর্জনের পেছনে। অধিকাংশ মানুষ তাদের চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-সাধনা ও পরিশ্রম ব্যয় করেন পার্থিব সম্পদ উপার্জনের পেছনে। কীভাবে বেশি সম্পদ অর্জন করা যায়, সেই প্রতিযোগিতা চলে দিনের অধিকাংশ সময়। কার বেশি সম্পদ, কে বেশি ধনী, কার কী বেশি আছে, কার ছেলে বিদেশে আছে, কার সন্তান ডাক্তার - এ নিয়েও চলে লাগামহীন অহংকার। মানুষ সন্তান কামনা করে এবং সন্তান ধনী হলে সেটা নিয়ে বড়াই করে, অহংকারী হয়ে যায়। সন্তান না হলে হয়ে যায় পাগলপারা। সন্তান পাওয়ার জন্য চষে বেড়ায় পুরো দুনিয়া। অথচ সম্পদ ও সন্তান দুটোই পার্থিব জীবনের তৃপ্তি ও সৌন্দর্য। এর ফল মানুষ পৃথিবীতে ভোগ করে। আসলে এর কোনোটিরই মূল্য নেই।

মানুষ শরীরের ব্যাপারে যতটুকু সচেতন, অন্তরের ব্যাপারে ঠিক ততটুকুই উদাসীন। শরীরের পরিচর্যায় মনোযোগী হলেও অন্তরের পরিচর্যায় মোটেও মনোযোগী নয়। বিপদ কিন্তু, সেই অন্তর থেকেই আসতে পারে। বাহির আর অন্তরকে যদি না সঠিক ব্যবহার করা হয়, অন্তরকে যদি না শুধহ করা হয়, কথায় আর কাজে যদি না মিল থাকে – তাহলে আমাদের ভাগ্যও সেইভাবে গড়ে উঠবে। আজ, নাহয় কাল সেই ‘রোগ’ ফুটে বেরোবে।




আমাদের মনে রাখা উচিত - অন্তর পরিশুদ্ধ না হলে জীবনের কোনো কিছু সুন্দর ও সুস্থভাবে পরিচালিত হয় না। যার অন্তর সুন্দর হয় তার জীবনও সুন্দর হয়। আর যার হৃদয়-মন হয় কলুষিত তার জীবনও হয় কলুষিত। শারীরিক সুস্থতার জন্য যেমন সচেতনতা ও চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়, তেমনি অন্তরের পরিশুদ্ধতার জন্যও নিয়মিত পরিচর্যা ও চেষ্টা অব্যাহত রাখাটা জরুরি। 

 বেশ কিছু স্ত্রীকে তাদের স্বামীর উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছি – “এবার একটু পরিবারের দিকে তাকাও, সারা জীবনতো অর্থের পিছনেই দৌড়ে গেলে, ছেলে-মেয়েতো তোমাকে ছাড়াই বড় হয়ে গেল। কতটা সময় তুমি ওদের দিয়েছো? আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। সম্পর্কের কথাও একটু ভাবতে হয়।

 বহু স্বামী উত্তর দেন –‘ পয়সা কি আমি শুধু আমার নিজের জন্য উপার্জন করছি! তোমরা সবাই যাতে ভাল থাকে, সেজন্যই তো ছুটে মরছি। তোমাদের আরো ভাল রাখার জন্যই তো আমার পরিশ্রম। আমার কি ভাল লাগে এইভাবে ছুটতে?’ আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ঠিকই তো বলেছেন তারা। অর্থ ছাড়া কি মানুষ ভাল থাকতে পারে? পারে না। 

কিন্তু, বাবাজী মহারাজ বলছেন তোর যতটুকু প্রয়োজন, সেইটুকুতেই তোর অধিকারঅতিরিক্ত অর্থ বা অর্থের লোভ, আরও সমস্যা ডেকে আনে। 

গীতার পঞ্চম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ যেমন অর্জুনকে বলেছেন কীভাবে জীবনে সফল হবেন। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং আত্মৈব হ্যাত্মনো নাত্মানমবসাদয়ে

বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ ।। 

অর্থাৎ- নিজের মাধ্যমে নিজেকে সংসার থেকে উদ্ধার করবে এবং নিজেকে কখনও অধোগতির পথে যেতে দেবে না; কারণ মানুষ নিজেই নিজের বন্ধু ও নিজেই নিজের শত্রু। 

নিজের নিজেকে উদ্ধার করা কাকে বলে? সেকথাও বলেছেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি বলেছেন, জীব অজ্ঞতার বশ হয়ে অনাদিকাল থেকে এই দুঃখময় সংসার-সাগরে আবর্তিত হয় এবং নানাপ্রকার উচ্চ-নীচ যোনীতে জন্ম নিয়ে বহুপ্রকার ভয়ানক কষ্ট সহ্য করতে থাকে। জীবের এই দীন দশা দেখে দয়াময় ভগবান তাকে সাধনোপযোগী দেবদুর্লভ মনুষ্য-শরীর প্রদান করে এক সুন্দর সুযোগ দিয়ে থাকেন, যাতে সে ইচ্ছা করলে সাধনার মাহাত্ম্য একজন্মেই সংসার সমুদ্র থেকে মুক্তিলাভ করে সহজেই পরমানন্দ স্বরূপ পরমাত্মাকে লাভ করতে পারে।




গীতা এখানে ভগবান নিজের সাহায্যে নিজেকে উদ্ধার করার কথা বলে জীবকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছেন যে, “তুমি মনে করো না যে তোমার প্রারব্ধ-খারাপ, তোমার তাই উন্নতিই হবে না। তোমার উত্থান-পতন প্রারন্ধের অধীন নয়, তা তোমারই হাতে। সাধনা করো আর নিজেকে অবনতির গহ্বর থেকে বার করে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাও।" 

স্বামী শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ বাবাজীকে বলেছিলেন – ‘মনের ময়লাদূর করতে পারলেই ভগবানের অস্তিত্ব অনুভব করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা আবার বলি-

একদিন বৃন্দাবন আশ্রমে দাদাজী মহারাজ বাবাজীকে মন্দিরের দরজাটা পরিষ্কার করতে বললেন। অ্যাসিড জাতীয় পদার্থ দিয়ে বাবাজী দরজাটা পরিষ্কার করছিলেন। এইভাবে পরিষ্কার করতে করতে বাবাজী মহারাজ দেখলেন রূপার পাতের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরিষ্কার করার পর বাবাজী দেখলেন রাধা-কৃষ্ণের একটা চিত্র 

শ্রীজানকীদাসজী বাবাজীকে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘তুমি চিত্রটিকে কি বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছিলে?’ বাবাজী বললেন –‘না বাবা, কিন্তু চিত্রটি ওখানে ছিল। 

দাদাজী মহারাজ বললেন – ‘কেন তুমি দেখতে পাচ্ছিলে না?’ 

বাবাজী জানালেন – ‘দরজায় এত ময়লা জমে গিয়েছিল যে চিত্রটি তাতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। শ্রীজানকীদাসজী তখন বাবাজীকে বলেন – ‘এটাই তোমার হৃদয়ের ঘটনা। ওখানে এত ময়লা জমে আছে যে তোমার হৃদয়স্থিত ভগবানকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না। হৃদয়ের ময়লাকে পরিষ্কার কর। তোমার ভগবান তোমার কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়বে।

 


সুতরাং মানুষকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সদা-সর্বদা নিজের উত্থানের, বর্তমান স্থিতির থেকে ওপরে ওঠার, রাগ-দ্বেষ, কাম-ক্রোধ, ভোগ, ও পাপাচার সর্বতোভাবে ত্যাগ করে শম, দম, তিতিক্ষা, বিবেক, বৈরাগ্য ইত্যাদি সদ্গুণ সংগ্রহ করে, বিষয়-চিন্তা ত্যাগ করে শ্রদ্ধা ও প্রেমসহ ভগবদ চিন্তা করা ও ভজন-ধ্যান ও সেবা সৎসঙ্গের মাধ্যমে ভগবানকে লাভ করার সাধনায় রত হওয়া উচিত। যতক্ষণ ঈশ্বর লাভ না হয় ততক্ষণ এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটা বা থেমে যাওয়া উচিত নয়। ভগবৎকৃপার বলের ওপর ধৈর্য, বীরত্ব ও দৃঢ়নিশ্চয়তার সঙ্গে নিজেকে স্থির রেখে উত্তরোত্তর উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া উচিত।

মানুষ নিজ স্বভাব ও কর্ম যত বেশি সংশোধন করতে পারবে ততই সে উন্নত হবে। স্বভাব ও কর্মের শুধরানোতেই উন্নতি এবং উত্থান : অপরপক্ষে বিপরীত স্বভাব ও কর্মে দোষের বৃদ্ধি হল অবনতি বা পতন।

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad