খোলা মনে
তারক ঘোষ
উপরের কথাগুলির কিছুটা অংশ পদাবলীকার চণ্ডীদাসের। তিনি লিখেছিলেন, "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।“ তার লিখে যাওয়া শতাব্দী-প্রাচীন এই কথাগুলো তার সত্য ও আভিজাত্য নিয়ে বহু সময় কাটিয়ে দিয়ে গেছে। তার বলে যাওয়া কথা নিয়ে কোনদিনই দ্বি-মত ছিল না। কিন্তু, এই কথাগুলোর উপরে আজ কি কোথাও মলিনতার ছাপ পড়েছে? কোথাও কি মনে হচ্ছে, আমরা তার এই বহুপঠিত, বহুচর্চিত কথাগুলোর অর্থই বুঝতে পারিনি!
সত্যই কি আজ সবার উপরে মানুষ সত্য? সত্যই কি মানুষের উপরে কেউ নেই? মানবতাই কি শেষ কথা? মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি এই কথা, কিন্তু যখন দেখি, রাশিয়া আর ইউক্রেনের ‘মহারাজদের’ যুদ্ধে মরছে মানুষ, অতি সাধারণ মানুষ। শিশুরা স্বপ্ন দেখার আগেই আশ্রয় নিচ্ছে কবরে। সোনালি ফসল ঢেকে যাচ্ছে বারুদে…তখন কি মনে হয়, মানুষ সত্য? না কি ধ্বংস্ সত্য? হয়তো, মানুষ সত্য, কিন্তু মানবতা চলে গেলে মানুষের আর কী থাকে?
আর দু একটি কথা বলার আছে। যা নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। বিষয়টা হলো ধর্ম। ‘ধর্ম’ শব্দটা ছোট্ট, কিন্তু এর ব্যাপ্তি বিশাল। দুঃখের বিষয়টা হলো, আমরা এই ‘ধর্ম’কে ক্ষুদ্রার্থে দেখছি, তাই নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। পিতার ধর্ম, মাতার ধর্ম, সমাজের ধর্ম থেকে রাজধর্মে পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। আমরা প্রত্যকেই আপন আপন ধর্ম পালন করি আমাদের বিশ্বাস অনুসারে। ধর্ম-আচার সব যার যার মতো। এখানে কোন বিভাজন নেই, রঙ নেই, নেই পরাধীনতা।
কিন্তু আর একটি শব্দ আছে এই ‘ধর্ম’ দিয়ে। সেটি হলো ‘ধর্মান্ধ’। আর এটাই ভয়ঙ্কর। আর এই ধর্মান্ধতার জন্য মাঝে মাঝেই সংশয় জাগে। সবার উপরে মানুষ সত্য, এটাই ঠিক তো?
আমার বিশ্বাস আমার উপরেই। অন্যের ধর্ম নিয়ে আমরা যদি কোনো মন্তব্য করি, সেটা একটা আঘাত। তার ধর্মের প্রতি, তার চেয়েও বড় কথা তার বিশ্বাসের প্রতি। কিন্তু আমরা যদি আর একটু সহনশীল হই। সকলে বিচার ও বুদ্ধি দিয়ে আলোচনা করি, হিংসার পথে না গিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে নিশ্চয় একটা পথ বেরিয়ে আসবে। কিন্তু, ওই যে ধর্মান্ধতা! আমাদের সত্যই অন্ধ করে ফেলে। আর শেষ কথা হলো রাজধর্ম। আবার সেই ধর্ম, মানে রাজার ধর্ম কী? তিনি নিশ্চয় বিচার করে দেখবেন, কী করা উচিত। প্রজাদের কোনো জাত নেই, কোনো বর্ণ নেই। রাজারও কোনো ধর্ম নেই। তিনি শুধু আর একবার মনে করিয়ে দেবেন – “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নেই।“