শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ২৮

নানারূপে তিনি আসেন ভক্তদের বিপদ থেকে সাবধান করতে, উদ্ধার করতে 

 তারক ঘোষ 

পর্ব  ২৮

 বাবাজীর লেখা “অলৌকিক পুরুষ – জানকীদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ” প্রবন্ধের এক্টুখানি অংশ দিয়ে আজকের লেখা শুরু করি। এর একটা কারণ আছে। সদগুরুদের জীবনে যেমন নানা ধরণের অলোউকিক ঘটনা ঘটে, তেমনই সদগুরুদেবরাও বারে বারে মর্তধামে নেমে আসেন তাদের ভক্ত শিষ্যদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।
 তারা উচ্চধামের মহাপুরুষ, তারা যা দেখতে পান, আমাদের বিষয়ী চোখ তা দেখতে পায় না। কিন্তু তারা আসেন মৃত্যুর আগেও, পরেও। আমরা চিনতে পারি না, কারণ, আমাদের সামনে তারা আসেন সাধারণ মানুষের বেশে। যে অভিজ্ঞতার কথা আমি গতকাল থেকে লিখছি। 
  আমি সকলের বোঝার সুবিধার জন্য বাবাজীর মূল লেখা সাধু ভাষা থেকে চলিতে করে দিয়েছি, মার্জনা করবেন।

বাবাজী লিখছেন – “ছোটবেলাতেই বাবাজী মহারাজ যেভাবে দীক্ষালাভ করেন তা ছিল অলৌকিক। এরকম অনেক অলৌকিক ঘটনা তার জীবনে ঘটত। তিনি ঈশ্বর পাগল ছিলেন। আমাদের বলতেন –‘খুব ছোটবেলাতেই আমার খুব সুন্দর অবস্থা লাভ হয়েছিল।‘ একবার ঝুলন পূর্ণিমার দিন তিনি তার সমবয়স্ক কয়েকজন সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে আজমিরীগঞ্জের নিম্বার্ক আশ্রমে যাচ্ছিলেন ঝুলন উতসব দেখতে। 
বর্ষাকালে বাংলাদেশে সাধারণতঃ নৌকো করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয়। শ্রীশ্রী বাবাজী মহারাজও নৌকো করে যাচ্ছিলেন। হঠাত সকলে দেখেন তিনি সাষ্টাঙ্গে দন্ডবত হয়ে কাকে যেন প্রণাম করছেন। দন্ডব করে উঠলে সকলে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন – ‘তুমি কাকে প্রণাম করলে?’ বাবা প্রথমে কিছু বলতে চান নি। পরে তাদের অনুরোধ এড়াতে না পেরে বললেন যে – ‘আমি আমাদের এই নৌকোর সঙ্গে সঙ্গে শ্রীশ্রী রামদাসজী কাঠিয়াবাবাজী মহারাজকে আকাশ মার্গে যেতে দেহেছিলাম। আমি তাকে দন্ডবত করেছিলাম।‘
আসলে এই দর্শন হয়, সবাই দেখতে পান না। কারণ, আমরা অতি সাধারণ মানুষ। ধর্মে মতি আছে ঠিকই, কিন্তু, আজো নিষ্কাম কর্ম করতে পারিনা। সংসারে থেকে অনেক সমস্যার মোকাবিলা করতে গিয়ে তাদের ডাকার সময়ও পাই না। কিন্তু, তারা ভোলেন না। শিষ্যদের বিপদে নিজেরাই হাজির হয়ে যান। কারণ কাঠিয়বাবার নৌকায় যিনি উঠেছেন, তার সব দায়িত্ব বাবাজী মহারাজের, নিম্বার্ক সাধকদের। 
যাইহোক, যা বলছিলাম। ট্রেনে সেদিন ভিড় নেই। আমার আসন সংরক্ষণ করা আছে এস ফাইভ কামরায় । সেই কামরায় উঠতে গিয়ে খেয়াল হল গাড়িতে এখনও ইঞ্জিন জোড়া হয় নি, তাই কামরাগুলো অন্ধকার । অবশ্য, ট্রেন ছাড়তে এখনও দেরি আছে । প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে এখন রাত ন’টা । ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন যাত্রীরা । রাতের এই ট্রেনটায় গত দুদিন ভিড় হচ্ছে না । দিন তিনেক আগে আগে কামরূপ এক্সপ্রেসে উগ্রপন্থী হামলা হওয়ার পর অনেকেই রাতের এই ট্রেনটা এড়িয়ে চলছেন ।
যাইহোক, টর্চটা জ্বেলে উঠে পড়লাম । কামরাটা অবশ্য পুরোপুরি অন্ধকার নয়, প্ল্যাটফর্মের উজ্বল আলোগুলো উঁকি মারতে গিয়ে কামরাগুলোকে আধো আলোকিত করে রেখেছে । নিজের লোয়ার বার্থটা খুঁজে বসেও পড়লাম । এবার নিশ্চিন্ত, যখন ইচ্ছা ইঞ্জিন জোড়া হোক, ছাড়ুক । আমার আর ছোটাছুটির প্রয়োজন নেই । একটা সিগারেট ধরালাম, বে-আইনি জেনেও . সারা দিনরাতের বাস জার্নি । চোখের পাতা সেই ভার বহন করতে পারল না, বুজে এল । আমাদের জীবনটাও যেন অদ্ভুত এক রেলগাড়ি, যার শুধু ‘আপ’ আছে, ‘ডাউন’ নেই । শুধুই সামনে ছুটে চলা । শৈশব, কৈশোর,যৌবন আর বার্ধক্যের স্টেশন ছুয়ে সেই অনন্তের দিকে । চা ওলার হাঁকডাকে চটকা ভেঙ্গে গেল আমার । স্মৃতিগুলো এক নিমেষে হারিয়ে গেল মনের গোপন কোন ঠিকানায় । পয়সা দিয়ে এক ভাঁড় চা নিলাম । ট্রেনের কামরা এখনো অন্ধকার । দু-চার জন যাত্রী সেই অন্ধকারেই সিট খুঁজে বসে পড়েছেন । ঠিক আমারই মতো । তাকিয়ে দেখলাম, গোটা কামরায় যাত্রীর সংখ্যা ৫। আমার সামনের বার্থ ও আমি যেদিকে আছি সব ফাঁকা। একটা চাপা আতঙ্ক। কারণ, গত কদিন এই রুটে উগ্রপন্থী হানার একটা আশঙ্কা ছিল।
ট্রেনে ইঞ্জিন জোড়া হল । পটাপট জ্বলে উঠল কামরার আলোগুলো । করিডোরের পাশে জানালার ধারে এক পাঞ্জাবী মহিলা, সঙ্গে একটা বাচ্চা । ভদ্রমহিলার মুখ অজানা ভয়ে শুকনো । হয়তো কামরূপ এক্সপ্রেসের ঘটনাটা জেনেও সেই পথেই যেতে হচ্ছে ভেবে । আমার সামনে লোয়ার, মিডল, আপার বার্থ ফাঁকা । হয়তো অন্য কোন স্টেশন থেকে কেউ উঠবে । 
ঘড়ির দিকে তাকালাম, রাত সাড়ে দশটা । প্ল্যাটফর্মেও বেশ ব্যস্ততা । মনে হয় সিগন্যাল হয়ে গেছে । আমার ধারণাকে সত্যি করে ট্রেনের বাঁশি বেজে উঠল । শেষবারের মতো কামরাটা চেক করে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ল আর পি এফের এক জওয়ান । এমন সময় দু জন ভদ্রলোক উঠলে আমাদের কামরায়। আমার সামনের আপার বার্থে ব্যাগ রেখে আমার সামনের আসনে বসলেন এক মধ্য চল্লিশ বছরের ভদ্রলোক। 
তাকিয়ে দেখলাম, পরনে জিন্সের প্যান্ট, গায়ে জ্যাকেট। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। প্রত্যুত্তরে হাসলাম। ততক্ষণে, আর এক ভদ্রলোক আমি যেদিকে আছি, সেদিকের আপার বার্থে উঠে পড়লেন। আমার সামনের ভদ্রলোক বললেন, ‘কদ্দুর?’ 
বললাম, ‘বর্ধমানে নামবো। আপনি?
তিনি হেসে বললেন,‘মালদা। ওখানে নেমে বিহারের একটা জায়গায় যাবো।‘ 
উপরের ভদ্রলোক আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমায় কলকাতা যেতে হবে, যা শুনছি, বিপদ হবে না তো?’ 
ওই ভদ্রলোক আবার হাসলেন, ‘বিপদ কোথায় নেই, বলতে পারেন। বিপদ তো মনেই থাকে। ভয় ছাড়ুন।‘ 
বেশ শীতের রাত। ট্রেন খুব ঢিমেতালে চলছে, কারণ সামনে একটা ইঞ্জিন যাচ্ছে এস্কর্ট হিসাবে। লাইনে কিছু থাকলে যাত্রীবাহী গাড়িটা যাতে বেঁচে যায়। মনের মধ্যে ছোট্ট একটা ভয়। হাসলেন সামনের ভদ্রলোক, বললেন, ভয় নেই। চ
মকে উঠলাম। উনি কি মন পড়তে পারেন না কি? 
হেসে বললাম, “না, ভয় নয়।“
 উনি বললেন, “গীতা পড়েন?” 
বললাম, “না, নিয়মিত পড়ার অভ্যাস নেই। তবে পড়ি। সময় হয়না তো।“ 
উনি হাসলেন, বললেন, “বিশ্বাসটাই সব, বুঝলেন। আপনাকে একটা গল্প বলি।“ ট্রেন চলছে। কামরা খালি। মনে ভয়। তাই ভাবলাম, শোনাই যাক গল্পটা। বললাম, বলুন।
উনি শুরু করলেন – শ্রীরাধা একবার যমুনা পা্র হয়ে অপর পারে যাবেন। কৃষ্ণজী তাকে একটা পত্রে কিছু লিখে দিয়ে বললেন, ‘এটা সঙ্গে নিয়ে চলে যাও। জলের উপর দিয়েই যেতে পারবে। রাধারাণী পরম ভক্তিভরে, সেই পত্র নিয়ে যমুনা পার হয়ে অপর পারে পৌছালেন। ফেরার সময়, তিনি যখন মাঝ যমুনায়, আচমকাই তার ইচ্ছে হলো – দেখিতো কী এমন লেখা আছে, যার জন্য হেটেই যমুনা পার হতে পারছি। যেই ভাবা, সেই কাজ।
 কাগজটা খুলে দেখলেন, শুধু কৃষ্ণ নাম। আর ঠিক তার পরমুহুর্তেই, তিনি আর হাঁটতে পারলেন না, দেখলেন তিনি জলের মধ্যে ভাসছেন।“ গল্প থামিয়ে তিনি হাসলেন, বললেন, যতক্ষণ রাধারাণী কৃষ্ণজীর কথাতেই বিশ্বাস করেছিলেন, ততক্ষণ তিনি নিশ্চিন্তে নদী পার হয়েছেন। যেই সন্দেহ এলো, বিশ্বাস হারিয়ে গেল। 
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad