বাবাজী মহারাজ তিনটি কথা প্রা্য়ই বলতেন… কিন্তু বেশিভাগই সে শিক্ষা নেন না বলে আক্ষেপ ছিল তার

তারক ঘোষ 

 ‘গুরু লাভ’ প্রবন্ধে বাবাজী মহারাজ বলছেন – গুরুদেব সর্বব্যাপী। সব জায়গায় পূর্ণরূপে তিনি তোমার সঙ্গে আছেন। তুমি যেখানেই থাক, মাঠে-ঘাটে, স্কুলে সর্বত্র পূর্ণরূপে তিনি তোমার সঙ্গে বিরাজমান, তোমাকে দেখছেন, এই বোধ থাকা ভালো। শিষ্য যেখানেই থাকুন, সেখান থেকেই তিনি যদি শ্রীগুরুচরণে প্রার্থনা, সেই প্রার্থনা যদি ঐকান্তিক হয় এবং হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উদগত হয়, তবে গুরুদেব তা পূর্ণ করবেন।
আর এর বহিঃপ্রকাশের সাক্ষী অনেকেই। কেউ হয়তো বুঝতে পারেন না, কেউ বা পারেন। তিনি যে কখন কোন রূপে আপনার সামনে আসবেন, আপনি বুঝতেও পারবেন না। হয়তো আপনার পরীক্ষা নেওয়ার জন্যই তিনি এসেছিলেন, চলে যাবার পর মনে হলো- ‘ এই রে…” 
বাবাজী তিনটি কথা মাঝে মাঝেই পাঠচক্রে বলতেন। এর একটা হল – শ্মশান বৈরাগ্য। কথাটা বহু প্রাচীন কাল থেকেই প্রবচন হিসাবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু, এই কথাটা বলে বাবা তার ব্যাখ্যা দিতেন। একই সঙ্গে বলতেন, ঈশ্বরের পথে চলতে গেলে ‘শ্মশান বৈরাগ্য’ ত্যাগ করে মনকে সত্য সত্যই বিরাগী করতে হয়। কিন্তু ভগবান কৃপা না করলে বৈরাগ্য আসে না। মনকে জয় না করা পর্যন্ত বৈরাগ্য আসার রাস্তাটাই তৈরী হয় না।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সব বস্তুকে যেমন চুম্বকে পরিণত করা যায় না। চুম্বক তৈরির জন্য লাগে লোহা। কিন্তু লোহা দিয়ে চুম্বকও একসময় চুম্বকত্ব হারায়, তেমনি মনও অনেক কিছু হারায়। এখন, বাবার সামনে বসে আমার মনে হলো, কাল থেকে আজেবাজে ভাবনা-চিন্তা ছেড়ে দেব। 
সত্যি তো জীবনে ভোগের পিছনে ছুটে কী হবে, কিছুই না। নারীদেহ তো রক্ত-মাংসের, আজকের রূপ, কাল সময়ের হাতে পরে ধ্বংস হয়ে যাবে, কী হবে পরনারীকে নিয়ে ভেবে! সবই অসার। মায়ার পৃথিবীতে সবই ক্ষণকালের। একমাত্র সত্য, চিরাকালীন হলো ঈশ্বর ও সদগুরু। 
আমরা তো ঈশ্বরকে পাইনা, কিন্তু সদগুরুকে পেতে পারি। তার কথা শুনে চলতে পারলেই আমরাও সেই আনন্দ পথের সন্ধান পেতে পারি। হ্যা, এই ভাবনা গুলোই আসে। অন্ততঃ যতক্ষণ, বাবার পাঠ শুনতাম।
 অনেককেই দেখেছি আশ্রম ছেড়ে বাড়ি ফেরার সময় কেমন উদাস হয়ে যেতেন। একজন তো বলেই ফেলেছিলেন –ভাবছি, এবার এত জমিজমা আর রাখব না, কিছুটা বিক্রি-বাটা করে মানুষের কল্যাণে ব্যয় করব। তাকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল – এইরকম একটা মানুষকে আমরা ভুল জানতাম এতদিন। ওর মন এত উদার। বাবাজীর উপর মনটা আরো আকর্ষিত হতো। 
ভাবতাম, উনিই তো এই রকম একটা মানুষের মনকে একেবারে বদলে দিতে পেরেছেন।
 কিন্তু, মাস ছয়েক পরেই সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। আমায় দেখেই চিনলেন। 
বললাম, কিছু করলেন? 
উনি হেসে বললেন, এই তো, মাস দুয়েক আগে কয়েক একর জমি কিনলাম। একটা হাউসিং এস্টেট করছি। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাটা এবার শুরু করতে যাচ্ছি। আসলে কী জানেন, টাকায় টাকা আনে আর মাটি মানেই তো টাকা। 
 আমি সায় দিলাম, ঠিক বলেছেন। 
মাটির উপর দাঁড়িয়ে আমরা আজো ভাবতে শিখি নি, এই মাটির এক ইঞ্চি জায়গার উপর আমার একদিন অধিকার থাকবে না। যেখানে দাহ করা হবে, সেখানে থেকে যাবে কয়েক-মুঠো ছাই। দুদিন পরে সেই ছাই অন্য কারো ছাই এর সঙ্গে মিশে যাবে। এটাই শ্মশানের নিয়ম। কিংবা আমাদের সবার শেষ পরিণতি। সবার নয়, যারা তাদের কর্ম দিয়ে সকলের মঙ্গল করে যাবেন, তাদের স্থান শুধু মানুষের মনের মধ্যেই থাকবে না। তার মূর্তি বসানোর জন্যও কিছু মানুষ দান করে দেবেন জায়গা। 
আর যিনি শ্মশানে গিয়ে বৈরাগ্য লাভ করবেন, আশ্রমে গিয়ে বিরাগী হবার কথা ভাববেন আর বাড়ি ফিরেই আবার সব ভুলে মেতে উঠবেন আপন কর্মে, যে কর্মে আছে শুধু তার ব্যক্তিগত লাভ, তিনি ছাই হয়েই থাকবেন, সেখান থেকে জন্ম নেবে না কোন ফিনিক্স। উপরের কথাগুলো ওই ভদ্রলোককে আর বলি নি। কেননা, বাবাজীর মতো মহামানব যাদের বোঝাতে পারেন না, আমি তো কোন ছার!
বাবাজী এই শ্মশান বৈরাগ্যের কথা বলতেন। 
আর এখনতো আরো দেখছি। দু-চোখ ভরে দেখছি। খুব কম মানুষই বোঝেন গুরুভক্তি মানেই হলো গুরু নির্দেশিত পথ নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা। আমি বাবার উপদেশ দু-কান ভরে শুনলাম। নিজের জীবনকে তার বলা কথার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম, ভুল পথে চলেছি। 
তারপর ঠিক করলাম, নাঃ কাল থেকেই তার কথা শুনেই চলবো। তিনি যেভাবে চলতে বলেছেন, সেই ভাবেই চলবো। কিন্তু, সেই কাল আর আসে না। ‘
জয়গুরু’ ‘গুরুর চরণে সহস্র প্রণাম’ বলেই আমাদের দায়িত্ব সেরে ফেলি। ফেসবুকে এরকম পোস্ট অনেক দেখি। এদের অনেককেই আমি আশ্রমে দেখেছি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম আর ভাবতাম, এদের মতো ভক্তি আমার নেই কেন! আশ্রম থেকে ফিরে এদের গুরুভক্তির সেই নিদর্শন সকলের কাছে বলতাম। কিন্তু, আজ  বাবার বলা  ‘শ্মশান বৈরাগ্য’ কথাটাই মনে পড়ে যায়। খুব কষ্ট হয় বাবার জন্য। উনি এত স্নেহ করতেন সকলকে।
যতক্ষণ আসনে বসে বাবার ছবির সামনে আমরা বসি, ততক্ষণই আমরা ভক্তি রসে আপ্লুত। সোস্যাল মিডিয়ায় বাবার ছবি দেখলে প্রণামের ধূম পড়ে যায়, কিন্তু, সেই পোস্টে কী লেখা আছে, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ কারো নেই। ভক্তি ফুটে উঠুক শুধু কথায় –কর্মে নয়। বাবা তাই বার বার বলতেন – ‘তোরা এক কান দিয়ে শুনবি, অন্য কান দিয়ে বের করে দিবি, কী হবে তোদের বলে!’ হয়তো, ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এসব কথা বলে গিয়েছিলেন। আর একটি কথা বলতেন – ‘ভবী ভোলবার নয়।‘ 
 চলবে

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad