বাবাজী মহারাজ বলতেন – ‘বৈরাগ্যের অহঙ্কার সবচেয়ে বড় অহঙ্কার, মানুষকে দাম্ভিক করে তোলে।‘

একবার স্বর্গের দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ভগবান বললেন, ‘বুঝলাম, তুই স্বর্গে যেতে চাস। কিন্তু কী নিয়ে এসেছিস সঙ্গে করে?’ সে বলল, ‘প্রভু, আমি এটিএম কার্ড আর এক বাক্স সোনার গহনা এনেছি।‘ ভগবান হাসলেন। এখানে ওসবের কোন মূল্য নেই। বুকে করে হরিনাম এনেছিস কি?
কজন সাধকের জীবনে সবচেয়ে বড় অহঙ্কার হল, বৈরাগ্যের অহঙ্কার। এই অহঙ্কার থেকে মুক্ত হতে না পারলে, তার পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছানো একেবারেই অসম্ভব। আর সাধারণ মানুষের জীবনে অহঙ্কার আর দম্ভ তার পতন ডেকে আনে। 
বাবাজী মহারাজ প্রবচনে নানা গল্পের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন –‘মহন্তাই পদবী সাধককে অন্তর্মুখী না করে বহির্মুখী করে দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই সমস্ত পদের মোহ সাধককে অহঙ্কারী করে তোলে।‘ 
কথা প্রসঙ্গে তিনি বলতেন - ‘কেউ কেউ আমিষ ছেড়ে নিয়ামিষ আহার করতে শুরু করেন। এইভাবে দিন কাটে, মাস কাটে, বছর কাটে। বেশ কয়েক বছর নিরামিষ খাওয়ার পর তার মনে হয়, আমি আমিষ আহারকারীদের থেকে ভগবানের দিকে অনেক এগিয়ে আছি। তখন তারা আমিষাশীদের একটু নীচু নজরে দেখতে শুরু করেন। ভাবখানা এমন, তারা ভগবানের পথে অনেক এগিয়ে গেছেন।“ 
বাবাজী বলতেন এইটাই অহঙ্কার। নিরামিষ খাওয়ার অহঙ্কার নয়। নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবার অহঙ্কার। এই অহঙ্কার ক্ষতিই করে। সাধক, এমনকি গৃহী মানুষের জীবনেও বৈরাগ্যের দরকার হয়। কিন্তু, সাবধান থাকতে হবে, এখানেও যেন অহঙ্কার না জন্মায়। 
বাবাজীর কথায় বৈরাগ্যের অহঙ্কার বড় অহঙ্কার। জ্ঞান দিয়ে এই অহঙ্কারকে খন্ডন করতে না পারলে সাধন পথে খুব বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। 


 বৈরাগ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বামী সন্তদাসজী বলেছেন – ‘তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আচরণ করেও, যখন তোমার অন্তরের শান্তি বিঘ্নিত হবে না, তখন বুঝবে বৈরাগ্য এসেছে।‘ কাঁচ আর কাঞ্চনের প্রভেদ যে কেউ করতে পারেন। কাউকে যদি বলা হয়, কাচঁ নেবে, না কাঞ্চন নেবে? প্রায় সবাই একবাক্যে বলে উঠবেন –‘কাঞ্চন নেব।‘ কারণটা যে শুধু লোভ, সেটা নয়। কাঞ্চন অর্থাৎ সোনা মানুষের জীবনকে সহজ করে দিতে পারে। 


কাঞ্চন যদি অর্থরূপে আসে, তাহলে, মনের মধ্যে থাকা সুপ্ত ইচ্ছেগুলো মানুষ পূর্ণ করতে পারে। সংসার চালানো, সন্তান পালন – ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, কেউ যদি যথেষ্ট অর্থ থাকা সত্বেও শুধু লোভের বশে অর্থের পিছনে দৌড়াতেই থাকে, তাহলে তার সেই দৌড় আর থামে না। থামে, একেবারে জীবনের শেষ লগ্নে যখন সে আর অর্থের ব্যবহার করতে পারে না। সে তখন বোঝে, কাঞ্চন জীবনের সব নয়, কিছুটা। কিন্তু, সে এই কাঞ্চন তথা অর্থ নামক সোনার হরিণের পিছনে দৌড়াতে গিয়ে এমন কিছু হারিয়েছে, যা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। 


আমি এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী, যা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। মানুষ অর্থ উপার্জনের নেশায় সবচেয়ে যে দামী জিনিষটি হারায়, তা হল সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই হোক, বা পিতা-মাতা-সন্তানদের পারস্পরিক সম্পর্কই হোক।
 বেশ কিছু স্ত্রীকে তাদের স্বামীর উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছি – “এবার একটু পরিবারের দিকে তাকাও, সারা জীবনতো অর্থের পিছনেই দৌড়ে গেলে, ছেলে-মেয়েতো তোমাকে ছাড়াই বড় হয়ে গেল। কতটা সময় তুমি ওদের দিয়েছো? আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। সম্পর্কের কথাও একটু ভাবতে হয়।“
 বহু স্বামী উত্তর দেন –‘ পয়সা কি আমি শুধু আমার নিজের জন্য উপার্জন করছি! তোমরা সবাই যাতে ভাল থাকে, সেজন্যই তো ছুটে মরছি। তোমাদের আরো ভাল রাখার জন্যই তো আমার পরিশ্রম। আমার কি ভাল লাগে এইভাবে ছুটতে?’ 


আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ঠিকই তো বলেছেন তারা। অর্থ ছাড়া কি মানুষ ভাল থাকতে পারে? পারে না। 
কিন্তু, বাবাজী মহারাজ বলছেন – তোর যতটুকু প্রয়োজন, সেইটুকুতেই তোর অধিকার। অতিরিক্ত অর্থ বা অর্থের লোভ, আরও সমস্যা ডেকে আনে। 
 অফিস, ট্যুর, ডাক্তারী, ব্যবসার পিছনে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষ আমি বহু দেখেছি, কিন্তু, তাদের মনে যে শান্তি নেই, সেটাও কথা প্রসঙ্গে জেনেছি। পরিবারকে সময় দিতে না পারায়, বহু স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছেন, বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমে জড়িয়ে পড়েছেন, এরকম ঘটনাও দেখেছি। ছেলে-মেয়ের জন্য সময় দিতে না পারায় পিতার সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধন আলগা হতেও দেখেছি। 
 আমার দেখা একজনের কথা বলি। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। সারা জীবন শুধু অর্থ উপার্জন করে গেছেন। স্কুলের মোটা বেতনেও তার মন ভরত না। তাই সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে ছাত্র-ছাত্রী পড়াতেন। স্কুল থেকে ফিরে আবার দুটো ব্যাচ। 


এইভাবে সারা সপ্তাহ চলত একই নিয়মে। দামী গাড়ি কিনেছিলেন, চোখধাঁধানো বাড়ি। তার বাড়ির দিকে তাকিয়ে লোকেরা যখন তার বাড়ির প্রশংসা করত, মনটা তার অহঙ্কারে ভরে উঠত। এক সময় তিনি রোগে পড়লেন। তার ছেলে সারা জীবন দেখে এসেছে, বাবা কীভাবে সম্পর্কের চেয়ে অর্থকেই প্রাধান্য দেন। ছেলেকেও তিনি সেই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন জীবনভর। ছেলেও বাবার কথাকেই গুরুত্ব দিয়েছে। তাই তার বাবার স্থান হল সরকারী হাসপাতালে। 
ডাক্তার বললেন, ‘এ রোগ এখানে ভাল হবার নয়, বড় জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, প্রচুর টাকার দরকার’। এরপর ছেলে পড়ল মহা ভাবনায়। কোনটাকে সে গুরুত্ব দেবে, অর্থ, না সম্পর্ক? বাবা তো বলেছে, অর্থই আসল বাবা-মা। অর্থই মানুষকে দেখবে। কেউ যখন পাশে থাকবে না, তখন অর্থই পাশে থাকবে। 


তাহলে সে কি করে! তাই সে ভাবতে থাকে, তার মেয়ে রয়েছে, তাকে ভালোভাবে মানুষ করতে হবে, তারপর বিয়ে দিতে হবে। বিরাট টাকার প্রয়োজন। শেষে সে ঠিক করল, বাবার তো বয়স হয়েছে। আর এক সময় সবাইকেই চলে যেতে হবে। তাই, সে আর বেশি পয়সা খরচ না করে, একটা নার্সিং হোমে ভর্তি করে দিল বাবাকে। 
মানসিক শান্তি এটাই- বাবার চিকিৎসা হচ্ছে, আর বেশি পয়সাও খরচ হবে না। যে কদিন বাঁচে বাঁচবে। আর সেই ভদ্রলোক, যিনি একসময় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন, কিন্তু পরিবার ছেলে-মেয়েকে সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধতে পারেন নি, সময়ের অভাবে। তিনি বোঝেন, আজ সবকিছুই তার হাতের বাইরে। এমনকি নিজের জন্য নিজের উপার্জন করা অর্থও তিনি ব্যয় করতে পারবেন না। 
এইটাই জীবন। যারা অর্থের জন্য সম্পর্ককে অবহেলা করেন, সন্তানদের ‘এটিএম’ মেশিনের মতো মানুষ করেন, তারা কী শিক্ষা পাবে? 


আবার বলি, সবাই এক নয়। বহু গরীব ছেলে মেয়ে তাদের বাবা-মাকে বাঁচানোর জন্য ভিক্ষা করেও অর্থ যোগাড় করে। কারণ, তারা জানে, অর্থের আসল কাজ মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করা।
 বাবাজী বলছেন – একবার স্বর্গের দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ভগবান বললেন, ‘বুঝলাম, তুই স্বর্গে যেতে চাস। কিন্তু কী নিয়ে এসেছিস সঙ্গে করে?’ 
সে বলল, ‘প্রভু, আমি এটিএম কার্ড আর এক বাক্স সোনার গহনা এনেছি।‘ 
ভগবান হাসলেন। এখানে ওসবের কোন মূল্য নেই। বুকে করে হরিনাম এনেছিস কি?

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad