বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাবাজী মহারাজকে বলেছিলেন –“তোমার গুরুজী দেখছি বাঘে-বলদে এক ঘাটে জল খাওয়াতে চাইছেন।“

 দাদাজী মহারাজ একদিকে যেমন ছিলেন লৌহকঠিন মানুষ, অন্যদিকে এক নিরাভিমানী সেবক। আশ্রমে আগত ভক্তদের তিনি সবিনয়ে বলতেন – ‘কেমন আছেন? আগে কিছু মুখে দিয়ে আসুন।‘ আর চলে যাবার সময় মধুর বাক্যে বলতেন – ‘আবার আসবেন।‘ 



বাবাজী মহারাজ ছিলেন এমন এক গুরুর শিষ্য, যার তুলনা খুব কমই আছে। কারণ শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ ছিলেন এক সুদৃঢ় মেরুদন্ড আর সুকঠিন মানসিক শক্তির অধিকারী। অন্যায়ের কাছে আর ‘অর্থ-যশ-মান-পদ’ এর কাছে তিনি কোনদিন আত্মসমর্পন করেন নি।
 তিনি ছিলেন নির্মল মনের অধিকারী, সুশিক্ষিত এক প্রকৃত সদগুরু। কাজেই তার শিষ্য প্রজ্ঞাদাসজী যে তারই পথের পথিক হবেন, এ নিয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। এই প্রসংগ থেকে একটু বেরিয়ে একটা কথা বলি। দাদাজী মহারাজ একদিকে যেমন ছিলেন লৌহকঠিন মানুষ, অন্যদিকে এক নিরাভিমানী সেবক। 


আশ্রমে আগত ভক্তদের তিনি সবিনয়ে বলতেন – ‘কেমন আছেন? আগে কিছু মুখে দিয়ে আসুন।‘ এতো এক অপূর্ব গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। আজ কে বলবে দাদাজী মহারাজ বা বাবাজী মহারাজদের মতো এই মধুর কথা! নেই, সেসব দিন চলে গেছে, সেসব সন্ন্যাসী বহু ভাগ্যে মেলে। 
এখন, সবাই গুরু। দু বছর সাধনা করেই গুরু হয়ে বসে পড়লেন পদের মোহে। আর ধনী শিষ্য ‘বাগিয়ে’ ‘একশ্রেণির গুরুরা’ ভোগের সমুদ্রে গা ভাসাতে শুরু করে দিলেন। 
কোথায় সন্ন্যাসীর আদর্শ, কোথায় জ্ঞান, কোথায় ভক্তি, কোথায় সাধনা! 


দাদাজী মহারাজের কণ্ঠে ছিল সেই আন্তরিকতা, যা আমরা দেখেছি বাবাজী মহারাজের মধ্যেও। আর পরবর্তী সময়ে আশ্রমে গিয়ে দেখেছি, এক ভক্তকে বলা হচ্ছে –‘আপনি কি দীক্ষিত? না হলে, বাইরে যান, ওখানে মুড়ি-চানাচুর কিনে খান। এটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়।"
 একেবারে ঠিক, ওইটাই তো বৈষ্ণবের ধর্ম, তাই না? অতিথি নারায়ণ – কারা বলেন একথা?
 হায়রে নির্বোধ! আপনারা আবার ভগবানের জন্য জপ-ধ্যান করছেন। ভগবান যে কোন রূপে সামনে আসেন, পরীক্ষা নিয়ে চলে যান, সবাই বোঝে না। অন্ধরা অন্ধই থাকে। তারা আবার মানুষকে কী শিক্ষা দেবে? 
শিষ্যরা যখন আশ্রম ছেড়ে বাড়ি ফিরতেন, দাদাজী মহারাজ বলতেন –‘আবার আসবেন।‘


 বাবাজী মহারাজ কোনদিন নিজের মতে চলতেন না, গুরুজী যা বলতেন, সেভাবেই এগিয়ে যেতেন। গুরুবাক্য নির্বিচারে পালন করাই ছিল তার কাছে প্রকৃত ধর্ম। কাজেই মাস্টারস করার পর তিনি সেই গুরুর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন।
 অর্থাৎ, এরপর কী? স্বভাবতইঃ শ্রীজানকীদাসজী তাকে বলবেন গবেষণা করার কথা। কারণ, শ্রীজানকীদাসজী বুঝে গিয়েছিলেন, তার এই শিষ্য সাধারণ শিষ্য নন, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে, এক ধর্ম ও সমাজ-সংষ্কারী মন। 
ঠিকই চিনেছিলেন শ্রীজানকীদাসজী। তাই, শিষ্যকে একান্তে বলেছিলেন – ‘তুই গবেষণা শুরু কর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।‘ 
আর ‘গুরু বিনা গতি নাই’ – এই তত্বে বিশ্বাসী বাবাজী মহারাজ গুরুজীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, গবেষণার বিষয় কী হবে। শ্রীগুরু তখন তার প্রিয় এই শিষ্যকে বললেন এমন একটা বিষয়, যা শুনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন হতভম্ব। অনুমতি কিছুতেই মেলে না। 
 জ্ঞানতপস্বী সাধক স্বামী জানকীদাসজী মহারাজের শিষ্য প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া যখন সমাজতত্বের এক দূরূহ বিষয় নিয়ে গবেষণায় পরিকল্পনা করেন তখন পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী শাসন চলছে। বামপন্থীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। জ্যোতি বসু তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তার দাপটে তখন রাজ্যে বাঘে গরুতে জল খাচ্ছে। 


এইরকম অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাবাজীর পেশ করা গবেষণার বিষয় নিয়ে মত দিতে পারছে না। কারণ, তারা বুঝতে পারছে না, সরকার যদি, কোন কারণে রুষ্ট হন। বাবাজীও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি হাল ছাড়লেন না। 
বারবার একই বিষয় নিয়ে আবেদন-নিবেদন করতে লাগলেন। কিন্তু, অনুমতি আর মিলছে না। বাবাজী মহারাজের বিষয় নির্বাচনকে কিছুতেই গুরুত্ব দিতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয়। বাবাজীকে বারবার হয়রানি করা হচ্ছে। বাবাজী আবার গুরুজীর কাছে দাঁড়ালেন। শ্রীগুরুর সাফ জবাব, - ওই বিষয়টাই হবে প্রজ্ঞাদাসজীর একমাত্র বিষয়। 


দাদাজী মহারাজ তার শিষ্যের গবেষণার বিষয় ঠিক করে দিয়েছিলেন – ‘বেদান্তের আলোকে মার্ক্সবাদ।‘ বাবাজী যখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তার গবেষণার বিষয় জানালেন এবং তার গুরুদেবের ইচ্ছার কথা জানালেন, কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিলেন –‘তোমার গুরুজী দেখছি বাঘে-বলদে এক ঘাটে জল খাওয়াতে চাইছেন।‘ 
কথাগুলো বিশেষ তাৎপর্য্যপূর্ণ। 
একদিকে নাস্তিকতা, অন্যদিকে আস্তিকতা। এই দুই বিপরীত বিষয় মিলবে কীভাবে! কাজেই, বাবাজী ফিরে এসে আবার শ্রীজানকীদাসজীকে জানালেন সেকথা। আর সেই কথা শোনামাত্রই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন শ্রীজানকীদাসজী।
 শিষ্যকে বললেন –‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানাও, তুমি গুরু নির্দেশিত বিষয় ছাড়া অন্য বিষয় নির্বাচন করতে পারবে না। বাবাজী মহারাজ সেই কথাই গিয়ে জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারণ, তার শ্রীগুরু বাঘে বলদে এক ঘাটে জল না খাইয়ে ছাড়বেন না। 
অবশেষে বহু টালবাহানার পর মিলল অনুমতি। ‘বেদান্তের আলোকে মার্ক্সবাদ’ নিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণাপত্র রচনায় মন দিলেন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া। ডঃ অমরনাথ ভট্টাচার্যের তত্বাবধানে শুরু হল গবেষণার কাজ। 


এইরকমই এক স্বাধীনচেতা, সত্যের পূজারী ছিলেন দাদাজী মহারাজ। একদিকে, মার্কসবাদ ও অন্যদিকে নিম্বার্কবাদ- দুটি ভিন্নমুখী ও ভিন্ন-চিন্তাধারাকে তিনি নিয়ে এলেন এক মঞ্চে। এটা এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ ছিল ওই ছাত্র জীবনে। কেননা, তিনি ছাত্র-জীবন থেকেই ভেবে নিয়েছিলেন, তার পথ হবে সমাজের মঙ্গল সাধনের পথ। 
অন্তরে সন্ন্যাসী এই ছাত্রের তপস্যা ছিল মানুষের জন্য তথা এই মানব-সমাজের জন্য এমন কিছু করা, যা সার্বিক মঙ্গল করবে সমগ্র সমাজ-ব্যবস্থার। বদলে যাবে, ভারতীয় সমাজের প্রচলিত ফর্মূলা। আর এইখানেই তার সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য। আর এই কারণেই ভবিষ্যতের ভারত যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে এই জ্ঞান-তপস্বী বিজ্ঞান-মনস্ক গবেষক সন্ন্যাসীকে, যার সঙ্গে আর কারো তুলনা হয় না- না জ্ঞানে, না মানুষের মঙ্গল বিধানের জন্য এক নতুন তত্বের আবিষ্কারক হিসাবে। 
১৯৯১ সালে, সমাজবিজ্ঞানের এই ছাত্র লাভ করলেন ডক্টরেট। তার এমএ ডিগ্রির সঙ্গে যুক্ত হল- পিএইচডি –ড.প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া। এখন দেখা যাক, এই বিষয়টা নিয়ে কেন এত আগ্রহ ছিল শ্রীজানকীদাসজীর। 

জানকীদাসজী বলছেন –“ছাত্রজীবন থেকেই কার্ল মার্কস ও তাঁর নীতির প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। অনেকে বিশ্বাস করেন যে মার্কসবাদী অর্থনৈতিক নীতিগুলি পৃথিবীতে স্বর্গ নিয়ে আসতে পারে এবং সমাজের সমস্ত মানুষের সম্পূর্ণ সন্তুষ্টির গ্যারান্টি দিতে পারে। আমি মনে করি, মার্কসবাদের ভিত্তি প্রস্তর হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। যা জগতকে কঠিন বাস্তবতা হিসাবে গ্রহণ করে এবং এর বাইরে কিছুই নয়। মার্কসবাদ ঈশ্বর, আত্মা বা সার্বজনীন ধর্মের জন্য কোনও বিশেষ জায়গা তৈরি করেছে কিনা তা নিয়ে আমার অনেক সন্দেহ রয়েছে। 

একজন ভারতীয় হিসাবে আমি সনাতন ধর্মের পথ অনুসরণ করে আমার জীবন যাপন করতে পছন্দ করি। বেদান্ত দর্শন অধ্যয়ন করার সময় আমি শঙ্করের চরম অদ্বৈতবাদের সংস্পর্শে এসেছিলাম যা জগতের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এবং ব্রম্ভাকেই একমাত্র বাস্তব হিসাবে স্বীকার করে। যেহেতু চরম অদ্বৈতবাদের মতবাদ আমাকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তাই আমি সত্যের সন্ধানে বেদান্ত দর্শনের অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম এবং শ্রী স্বামী নিম্বারকাচার্য মহারাজের দ্বৈতদ্বৈত বা দ্বৈতবাদী অ-দ্বৈতবাদের মতবাদের সংস্পর্শে এসেছিলাম। 
ভগবান নিম্বার্কের দেওয়া শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলির বিস্ময়কর যুক্তি এবং অনন্য ব্যাখ্যায় আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। এই তত্ত্ব অনুসারে ব্রহ্ম যেমন সত্য, তেমনই জগতও সত্য।  এই শিক্ষা আমাকে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্যকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।“ 

সঠিক শিক্ষার অভাব একটা জাতিকে পিছনে ফেলে দিতে পারে। সমাজে শিক্ষিত, কুসংষ্কারমুক্ত মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, সমাজ হয়ে উঠবে শক্তিশালী। এই সমাজের স্বপ্ন বাবাজী দেখতেন বলেই হাত দিয়েছিলেন এমন একটা গবেষণায়, যে গবেষণার ফসল, ভবিষ্যত সমাজের একটা মডেল। বাবাজী বলছেন – “The transformation of human society through dialectical materialism and class stuggle is nothing but transformation of Real manship to a True manship.”
 তিনি তাই বলছেন –“Human being is an organ of human society.” তিনি বলছেন –“ মার্ক্স বলেছেন – কম্ম্যুনিস্ট শাসনে ‘State will be withered away.’ মার্ক্সের সাম্যবাদের চিন্তা ভারতে নতুন কিছু নয়। আর ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে, ধর্মকে বাদ দিয়ে সাম্যবাদ আনার চেষ্টা ভয়ঙ্কর পরিণতির মুখোমুখী হতে পারে।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad