রাধা-কৃষ্ণের পার্থিব প্রেমের পিছনে আছে এক দার্শনিক মত, যা বুঝলে, খুলে যায় এক অন্য দিগন্ত ৩

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের প্রধান চরিত্র তিনটি। কৃষ্ণ, রাধা, বড়ায়ি। কৃষ্ণ পরমাত্না বা ঈশ্বরের প্রতীক, রাধা জীবাত্না বা প্রাণিকুলের প্রতীক ও বড়ায়ি এই দুইয়ের সংযোগ সৃষ্টিকারী অনুঘটক অর্থাৎ গুরু। মূলত রাধা-কৃষ্ণকথার আড়ালে ঈশ্বরের প্রতি জীবকুলের মিলনের চরম আকুলতা প্রকাশিত হয়েছে এই কাব্যে
নিন্দুক মানুষেরা মাঝেই মাঝেই বিষয় প্রসঙ্গে বলে থাকেন, “কৃষ্ণ করলে লীলা, আর আমরা করলে?” এই কথাগুলো প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়ে গেছে। আবার এসব কথা শুনে সাধারণ হিন্দুরা বলে থাকেন, “এসব অপপ্রচার মাত্র; কৃষ্ণ কখনো এমন ছিলেন না।“ 
আসলে কৃষ্ণের পার্থিব লীলা নিয়ে যেসব পদ রচিত হয়েছিল সেই সময়, তার একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়ে গেছে যুগে যুগে। কোনটা সত্য, কোনটা কবির কল্পনা – সেই ভেদ রেখাটাও হারিয়ে গেছে এক শ্রেণির মানুষের কাছে। 
পরকীয়া প্রেমের গন্ধে পাগল সাধারণ মানুষের চোখে রাধা-কৃষ্ণের ‘লীলা’ বোধগম্য হওয়ার কথা নয়, সবক্ষেত্রে তা হয়ও নি। কাজেই,এমতাবস্থায় মনে এক প্রকার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক- আসলে কে ঠিক বলছে? কে ভুল বলছে, কার কথা সত্য? – এ নিয়ে যুগে যুগে তর্ক রয়ে গেছে। কবি জয়দেব ‘গীতগোবিন্দে’ রাধার অমর প্রেম কাহিনী রচনা করেন। 
দ্বাদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব গোস্বামী সংষ্কৃত ভাষায় এই কাব্য রচনা করেন। ওড়িশার মন্দিরে ওড়িশি নৃত্যে ও সুরে গীতগোবিন্দ-গান উপাসনারই একটি অঙ্গ। এই গানের মধ্য দিয়ে অন্তঃসলিলা ভক্তিরস প্রবাহিত হয়েছে। এছাড়া অধিকাংশ গানে পূর্বরাগ, মিলন, বিরহ ইত্যাদি শৃঙ্গাররসের নানা বিভঙ্গ যুক্ত থাকে। শ্রোতা বা দর্শক জানেন কৃষ্ণভক্তিই মুখ্য উপপাদ্য, কিন্তু শৃঙ্গাররসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সে ভক্তি।
মেঘৈমেদুরমম্বরং বনভুব: শ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ। নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।
 ইখং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জদ্রুমং, রাধামাধবয়োর্জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃকেলয়ঃ।।

 ‘গীতগোবিন্দ’ এর প্রারম্ভের এই শ্লোক আজ নশো বছর ধরে শ্রোতা পাঠককে মুগ্ধ করে রেখেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ নেই। কেউ বেরোতেও চান না। ভক্তি ও প্রেমের মিশ্রণে যে অনুভূতি, তাকে কেউই হারাতে চান না। 
এই কাব্যের বিশিষ্ট সমালোচকরা বলেছেন - কাব্যের নিরিখে গীতগোবিন্দের বিচার করলে এর মান নিচু। শৃঙ্গাররসের কাব্য, অতএব দেহ ও সম্ভোগের বর্ণনা স্বাভাবিকভাবেই এখানে প্রত্যাশিত, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলি শালীনতাকে লঙ্ঘন করেছে। প্রথমদিকে যেটুকু ধর্মীয় উপাদান, সেটুকু বরং রুচিদোষ থেকে রক্ষা পেয়েছে। কখনো বা বিষয়গাম্ভীর্য এবং বর্ণনা সংযমে সত্যিই উৎকর্ষও লাভ করেছে।
তাহলে কী এই সমস্ত কাব্য সেই সময়কার পাঠকদের সন্তুষ্ট করার জন্য রচিত হয়েছিল? শৃঙ্গার রসের প্রয়োগে, এটি অনেকাংশেই হয়ে উঠেছিল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।
 কিন্তু, সত্যি কি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বা ‘গীত-গোবিন্দ’ কাব্য এটাই বোঝাতে চেয়েছে, না কি এর পিছনে রয়েছে এক জটিল তত্ব, যেটি সাধারণ মানুষের খুব একটা কাছের বিষয় নয়। একদিকে কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দের’ ব্যপক প্রচার ও অন্যদিকে নিম্বারক সম্প্রদায় মানুষের মাঝে রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে এলেন এক নতুন রূপে। এই যুগের আগে কোনও মন্দিরে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার পূজা হত না।


 রাধা যে কেবল কৃষ্ণের জন্য বেঁচে ছিলেন, আর তার জীবন এবং আত্মা সমস্ত কিছু কৃষ্ণকে উৎসর্গ করা হয়েছিল, এইসময়কার প্রধান গ্রন্থগুলিতে সে কথা উল্লেখ করা হয়নি। আবার, রাধার নাম ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে তবে খুব কমই উল্লেখ করা হয়েছে এবং কৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পরে তার সঙ্গে কী ঘটেছিল সং উল্লেখ করা হয়নি। 


প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে জয়দেব বা নিম্বারকাচার্যের আগে রাধার নাম উল্লেখ করা হয়নি কেন? অথবা কেন ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে তাঁর কোনও বিশদ বিবরণ নেই? উত্তরটি অজানা এবং আমরা সম্ভবত এই উত্তরগুলি জানতে পারব না।
 শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের 'বংশী খন্ডে' মদনবান নিক্ষেপ করার পর রাধার কৃষ্ণ অনুরাগ প্রবল হতে থাকে এবং 'বিরহ খন্ডে' তার চূড়ান্ত পরিণতি লক্ষ করা যায় । কৃষ্ণ বিরহে তিনি আর ঘরে থাকতে পারেন না, ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ করে পাগল হয়ে ওঠেন। রূপ-যৌবন, পতি- পরিজন, লাজ- লজ্জা, কুল-গোকুল সব ভাসিয়ে দিয়ে অন্ধ আবেগে কৃষ্ণ সন্ধানে তিনি ছুটে বেড়ান। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটিতে বেশ কয়েকবার উদ্ধৃত মর্মস্পর্শী একটি পদ —
“কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।“ এবার তাকানো যাক, ‘বিরহ খণ্ডে’র দিকে। আমরা এখানে কী দেখি? রাধা বড়ায়িকে বলছেন তার কৃষ্ণকে এনে দিতে। শুধু তাকে বলেই ক্ষান্ত হন না। নিজেও দই-দুধ বিক্রির ছল করে কৃষ্ণকে খুঁজতে বের হন। অবশেষে বৃন্দাবনে বংশী-বাদনরত অবস্থায় কৃষ্ণকে খুঁজে পাওয়া যায়। 
কৃষ্ণ রাধাকে বলেন, ‘তুমি আমাকে নানা সময় লাঞ্ছনা করেছো, ভার বহন করিয়েছো, তাই তোমার উপর থেকে আমার মন চলে গেছে’। রাধা বলেন, ‘তখন আমি বালিকা ছিলাম, আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার বিরহে মৃতপ্রায়। তির্যক দৃষ্টি দিলেও তুমি আমার দিকে তাকাও’। কৃষ্ণ বলেন, ‘বড়ায়ি যদি আমাকে বলে যে তুমি রাধাকে প্রেম দাও, তাহলে আমি তোমার অনুরোধ রাখতে পারি’। 
অবশেষে বড়ায়ি রাধাকে সাজিয়ে দেয় এবং রাধা কৃষ্ণের মিলন হয়। রাধা ঘুমিয়ে পড়লে কৃষ্ণ নিদ্রিত রাধাকে রেখে কংসকে বধ করার জন্য মথুরাতে চলে যান। ঘুম থেকে উঠে কৃষ্ণকে না দেখে রাধা আবার বিরহকাতর হন। রাধার অনুরোধে বড়ায়ি কৃষ্ণের সন্ধানে যায় এবং মথুরাতে কৃষ্ণকে পেয়ে অনুরোধ করেন, ‘রাধা তোমার বিরহে মৃতপ্রায়। তুমি উন্মাদিনীকে বাঁচাও’।
 কিন্তু কৃষ্ণ বৃন্দাবনে যেতে চান না, রাধাকে গ্রহন করতে চান না। কৃষ্ণ বলেন, ‘আমি সব ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু কটু কথা সহ্য করতে পারি না। রাধা আমাকে কটু কথা বলেছে’। (‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য এখানে ছিন্ন। পৃষ্ঠা পাওয়া না যাওয়ায়, এ কাব্যের সমাপ্তি কেমন তা জানা যায় নি।)
এভাবেই শেষ হয় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। এই কাব্যে উল্লেখ করা হয়েছে রাধা কৃষ্ণের মামী ছিলেন। রাধা ও কৃষ্ণ এক ‘অসামাজিক’ প্রেমে লিপ্ত হয়েছিলেন।ঙ্কাজেই প্রশ্ন ওঠে, এই কাব্যের মধ্যে রাধা ও কৃষ্ণকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেখানে কি আমরা খুঁজে পাই তাদের ঐশ্বরিক রূপ? 
এবার আমরা এর তাত্বিক ও দার্শিনিক তত্বের দিকে তাকাই। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের প্রধান চরিত্র তিনটি। কৃষ্ণ, রাধা, বড়ায়ি। কৃষ্ণ পরমাত্না বা ঈশ্বরের প্রতীক, রাধা জীবাত্না বা প্রাণিকুলের প্রতীক ও বড়ায়ি এই দুইয়ের সংযোগ সৃষ্টিকারী অনুঘটক অর্থাৎ গুরু। 
মূলত রাধা-কৃষ্ণকথার আড়ালে ঈশ্বরের প্রতি জীবকুলের মিলনের চরম আকুলতা প্রকাশিত হয়েছে এই কাব্যে। উইলিয়াম আর্চার ও ডেভিড কিন্সলি। এনারা হিন্দু দেব-দেবীর উপর নানা গবেষণা করে সারা বিশ্বে অত্যন্ত পরিচিত নাম। পেশায় অধ্যাপক ছিলেন। 
তারা কী বলছেন? তারা বলছেন - রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের গল্প হল ঐশ্বরিক-মানব সম্পর্কের রূপক, যেখানে রাধা হলেন মানব ভক্ত বা আত্মা। তিনি প্রকৃত ঐশ্বরিক প্রেমের আকাঙ্ক্ষা করেন। এই রূপক রাধা (আত্মা) কৃষ্ণ সম্পর্কে আরও জানতে, ভক্তিতে বন্ধনে এবং আবেগের সঙ্গে নতুন মুক্তি খুঁজে পান। কিছু মতবাদ অনুসারে রাধা রায়ান (যাকে অভিমন্যু বা আয়ানও বলা হয়) নামে আরেকজনকে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তিনি কৃষ্ণকে ভালোবাসতেন। 
 অনেকে এটাকে ঈশ্বরের প্রতি ব্যক্তির ভালোবাসা ও ভক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন যা সামাজিক সীমাবদ্ধতা দ্বারা আবদ্ধ নয়। রাধার স্বামী হিসেবে যাকে বলা হয়, সেই আয়ান ঘোষও যে একটা কাল্পনিক চরিত্র, তার প্রমান তার “ঘোষ” পদবী; এই ঘোষ পদবী মধ্যযুগের উৎপত্তি। 
কৃষ্ণের সময় ‘ঘোষ’ পদবী বলে কিছু ছিলো না। যদিও বৃন্দাবনের সবার পেশা ই ছিলো বর্তমানের একরকম ঘোষদের মতো। (চলবে)

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad