তারক ঘোষ
স্বামী প্রজ্ঞাদাসজী মহারাজ ছাত্রসমাজকে তাই বেছে নিয়েছিলেন উন্নততর সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ হিসাবে। তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমাদের কাজ হবে দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা। আর দেশকে গড়ে তুলতে হলে প্রথমে দরকার একতাবদ্ধ হওয়া আর দ্বিতীয় কথা হলো অশিক্ষা দূর করা।
ব্রিটিশ-শাসনে
থাকা একটি দেশের মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এক বাঙালি। স্বাধীনতার দোরগোড়ায়
এনে সেই দেশের বুকে তুলেছিলেন স্বাধীন পতাকা। তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র। আর এক বাঙালি
জাত-পাতের ভেদাভেদ আর কুসংষ্কারে আচ্ছন্ন দেশকে দেখিয়েছিলেন নবজাগরণ। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ।
আর তার বহুকাল পর আর এক বাঙালি চেয়েছিলেন, আমাদের দেশের সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে একটা
বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে, যেখানে একইসঙ্গে মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হবে, আর তার
সঙ্গে চলবে অধ্যাত্ববাদ। আর এই দুই বিষয় – জগত এর বাস্তবিকতাকে মেনে নিয়ে ঈশ্বরের সাধনা।
তিনি হলেন ডক্টর স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া।
আজ স্বাধীনতা দিবসের
প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে তার কথাই মনে পড়ে। যিনি একদিন গভীর আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন – “আমি
কেন এসেছি, কেউ আমার কাছে জানতে চায় নি।“
দূর্ভাগ্য আমাদের। এক অসামান্য সমাজতত্ববিদ ও অধ্যাত্ববিজ্ঞানীকে আমরা ফুল-মালায় শুধুমাত্র ‘গুরু’ সাজিয়ে পুজো করছি। তাকে ‘অলৌকিক ব্যক্তিত্ব’ বলে প্রচার করছি। অথচ ব্যক্তি স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া এই ‘অলৌকিকতা’র ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। কেননা তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী। নিম্বার্ক-তত্বে ঈশ্বর ও জগত, উভয়ই সত্য- এটা মেনে নেওয়া হয়েছে। তাই জগতকে উপেক্ষা করে ঈশ্বরের সাধনা সম্ভব নয়।
বাবাজী মহারাজ তাই জগতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে গিয়ে দেখেছেন, এখনো ভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে আছে সুবিধাবাদী মানুষের তৈরি করা বেশ কিছু কুসংষ্কার। যে কুসংষ্কার আমাদের ভারতের মানুষকে নবজাগরণের পথ থেকে অনেকটাই দূরে রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘কর্তার ভূত’ এর মতো কিছু প্রাচীন-ধ্যান-ধারণা, যেমন অলৌকিকতাবাদ, দেবতার ভর। বাবাজীর মতে, কোন মহিলা বা পুরুষের উপর দেবতার ভর বিষয়টা একটা বুজরুকি, ঈশ্বরের নামে অর্থ রোজগারের একটা অতি জঘন্য কৌশল।
আর একটি বিষয় হলো ডাইন প্রথা। যেখানে কাউকে ‘ডাইন’
তকমা দিয়ে প্রতিশোধ ও খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে আজও।
বাবাজী চেয়েছিলেন
আগে দেশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হোক আর এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভের প্রথম
ধাপটাই হল শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য। সমাজের প্রতিটি মানুষ যাতে সুশিক্ষিত হয়, এটাই
ছিল তার সাধনা। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন না হতে পারলে সুস্থ সমাজ গড়ে উঠে পারে
না। সুস্থ সমাজ গঠনের চাবিকাটি হলো, প্রতিটি মানুষের রোজগার। তাই তিনি বলেছিলেন, যে
মানুষকে প্রতিটি দিন সকালে উঠে ভাবতে হয়, কীভাবে দিন চলবে, মাথায় ছাদ নেই, ঘরে ভাত
নেই, ব্যাঙ্কে টাকা নেই, হাতে রোজগার নেই, তাকে কীভাবে ধর্মকথা বলবো। সে নেবেই বা কেন?
আগে তাই দরকার মানুষের রোটি-কাপড়া ঔর মকান, উসকে বাদ সবকুছ।
স্বামী প্রজ্ঞাদাসজী
মহারাজ ছাত্রসমাজকে তাই বেছে নিয়েছিলেন উন্নততর
সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ হিসাবে। তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমাদের কাজ হবে দেশকে সুন্দরভাবে
গড়ে তোলা। আর দেশকে গড়ে তুলতে হলে প্রথমে দরকার একতাবদ্ধ হওয়া আর দ্বিতীয় কথা হলো অশিক্ষা
দূর করা। একটা মানুষও যেন শিক্ষার আলোর বাইরে না থাকে। প্রতিটি বাড়িতে অন্ন, সুস্বাস্থ্য
আর শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে- এটাই উন্নততর দেশ গঠনের প্রথম শর্ত।
তিনি বলেছিলেন, এই দায়িত্ব নিতে হবে ছাত্রসমাজকেই। এটার দিকে লক্ষ্য রেখেই তারা বড় হয়ে উঠবে। এটাই ছিলেন আমাদের বাবাজী। উন্নতসমাজের প্রথম শর্ত দুটি হলো শিক্ষা আর অন্ন – সেটা তিনি বুঝেছিলেন। তিনি শুধু সন্ন্যাসী ছিলেন না। ভারতের বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের পথের পথিক ছিলেন তিনি। সমাজ গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন তার শ্রীগুরু স্বামী জানকীদাসজীর কাছে। আর এই জন্যই তার নিরলস গবেষণা চলেছিল।
সেই অসামান্য সমাজবিজ্ঞানীকে আমরা একশ্রেণির
মানুষরা শুধু ধর্মীয় গুরুরূপে পুজো করে চলেছি, তার কর্মকে অস্বীকার করে, সেই পথে তার
প্রচার না করে তাকে একপ্রকার ভুলে যেতে বসেছি। মানুষ না থাকলে দেবতা থাকে না। ভক্তই
ভগবানের প্রথম প্রিয়। আর গুরুর প্রিয় সেই শিষ্যরা, যারা তার মত ও পথকে অনুসরণ করে চলবে,
মূর্তি পুজো করে তাকে দূরে সরিয়ে দেবে না।
তাই তিনি ছাত্রসমাজকে
বলেছিলেন, আগে চাই সংহতি। হিন্দু-মুসলমানের নামে কেউ যাতে নিজেদের মধ্যে লড়াই না লাগিয়ে
দিতে পারে, এটা তিনি লক্ষ্য রাখার কথা বলেছিলে। স্বামী প্রজ্ঞাদাসজী বুঝেছিলেন ভারতের
সমাজব্যবস্থা পিছিয়ে থাকার মূল কারণগুলোকে – কুসংষ্কার, অশিক্ষা, অন্নাভাব, জাত-পাতের
নামে বজ্জাতি। আজ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে সংবাদ ভয়েস ৯ এর প্রতিটি সাংবাদিক-কর্মী
তাকে জানাই আমাদের প্রণাম।